প্রফুল্ল কুমার রায়। মাত্র ২০টাকা পুঁজি নিয়ে ১১ বছর বয়স থেকে ভারতে ট্রেন স্টেশনে কখনো লেবু, কখনো শসা বা পেয়ারা বিক্রি করে জীবনকে বদলে দিয়েছেন তিনি। সে বর্তমান শুধুমাত্র বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক নন, তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন গর্বিত ব্যবসায়ী। যিনি দিনের পরদিন খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করেছেন আজ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কয়েক শত পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি আয়ের অর্ধেক টাকা দান করছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, হিন্দু ও মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ও অসহায় মানুষের কল্যাণে।
প্রফুল্ল রায় ১৯৫৪ সালের একুশে সেপ্টেম্বর খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার প্রমদনগর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা অনিল কৃষ্ণ রায় ও মাতা পাতা রানী রায়। জন্মের পর থেকে পিতার দারিদ্রতার কষাঘাতে জীবন যুদ্ধে নামতে হয়েছে শিশু বয়স থেকেই। প্রাথমিক গন্ডি পার করলেও ষষ্ঠ শ্রেনীতে বেশিদিন পড়ালেখা করতে পারেননি তিনি। গ্রামের একটি বাজারে বাবার ব্যবসার সাথে কলাপাতা ও কচুপাতায় লবণের টোপলা বাঁধাই ছিলো তার জীবনে প্রথম কাজ। কিন্তু অভাবের ওই সংসারে সামান্য আয়ে তাদের নুন আনতে পানতা পুরাতো।
একপর্যায়ে প্রফুল্ল রায় ভাগ্য অন্বেষণে ১৯৭৩ সালে প্রথম দিকে মাত্র ২০টাকা নিয়ে কর্মের সন্ধ্যানে চলে যান ভারতে। সেখানে তিনি বিভিন্ন ট্রেন স্টেশনে লেবু, শসা বা পেয়ারা ফেরি করে বিক্রি করতেন। এ সময় তিনি ফার্নিচারের কাজও শিখতেন। এরপর দেশে ফিরে ঢাকাস্থ মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে একটি স’মিলে চাকরি নেন এবং যা আয় করতেন তা তিনি জমিয়ে রাখতেন। একপর্যায় খুলনা থেকে কাঠ নিয়ে চুক্তিতে কাজ করা শুরু করলেন। খুলতে লাগলো তার ভাগ্যের চাকা। কর্মে যোগ হয় আরো একটি পেশা ‘ঠিকাদারি’। এরপর থেকে তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানে সোনা ফলেছে।
১৯৯২ সালে পাথরের ব্যবসা ও ১৯৯৫ সালে ডুমুরিয়ার সীমান্তবর্তি কৈয়া এলাকায় ইট ভাটার ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি মাছের খাদ্য উৎপাদন এবং সেমি ইনটেসিভ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ শুরু করেন। গেলো বছর সরকারের অনুমতি নিয়ে ভেনামি চিংড়ি চাষ করে সফলতা পান। সরকার তার কাজের স্বীকৃতিস্বরপ ২০০৮ সালে মাছের খাদ্য উৎপাদনে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার এবং ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার গ্রহন করেন। সবমিলে এখন তার প্রতিবছরে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। উপার্জিত এ টাকার অর্ধেক টাকা তিনি বিভিন্ন সেবামূলক কাজে দান করছেন। ব্যাক্তি উদ্যোগে সীমা স্মৃতি বিদ্যাপীঠ নামে খুলনার কৈয়া এলাকায় একটি মাধ্যমিক ও ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইতোমধ্যে বিদ্যালয় দুটি সরকারিকরণ হয়েছে। সেখানে প্রায় ৬’শ ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করছে।
২০১৪ সালে সালতা নদীর জোয়ারের চাপে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৯ নং পোল্ডারের বাঁধ ভেঙ্গে টিয়াবুনিয়া এলাকা প্লাবিত হয়। অর্থ না থাকায় পাউবো কর্তৃপক্ষ বাঁধ মেরামত করতে গড়িমসি করে। এরপর প্রফুল্ল রায়ের উদ্যোগে নিজ অর্থায়নে ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধটি মেরামত করা হয়। চক শোলমারি থেকে হোগলবুনিয়া পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার রাস্তা সেমি-পাকা করণ, শোলমারী খেয়াঘাটসহ মানুষ চলাচলের ব্যবস্থাকরা, তেরখাদা প্রমদ নগরবাসীর যাতায়াতে সালতে খালের উপর কালর্ভাট নির্মাণ, বটিয়াঘাটা ব্রীজের পাশে রাস্তা নির্মাণ, মাদারিপুর গণেশ পাগলের আশ্রম, কৈয়া দুর্গা মন্দির, তেরখাদা নয়াবারাসাত মসজিদ, গল্লামারী হরিমন্দির, ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ মন্দির, মংলা ল²ীখালী গোপাল সাধুর মন্দির, কৈয়া পূর্ব জিলেরডাঙ্গা কওমী মাদ্রাসা, সাজিয়াড়া মাদ্রাসা উল্লেখ্যযোগ্য অনুদানসহ গাজীরহাট সোনাকড়ি গোবিন্দ মন্দির, তেরখাদা কলাবাজার তরনী মায়ের মন্দির, তেরখাদা প্রমদনগর কালিভিটা হরি মন্দির, চকশোলমারী শ্মশান কালি মন্দির, জিয়েলতলা মহামায়া আশ্রম, কৈয়া ইসলামাবাদ জামে মসজিদ, তেরখাদা প্রমদনগর গুরুচাঁদ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জমি ও নগদঅর্থ অনুদান দিয়েছেন প্রফুল্ল রায়।
সংসদ সদস্য নারায়ন চন্দ্র চন্দ বলেছেন, ‘প্রফুল্ল রায় একজন রুচিসম্মত উদার মনের মানুষ। তিনি একটা সময় অত্যন্ত আর্থিক ও অস্বচ্ছলতার মধ্যদিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। দৃঢ়তা ও অধ্যাবসায়ের সঙ্গে অত্যন্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন। বেশি শিক্ষিত না হয়েও বুদ্ধি খাটিয়ে এবং বিভিন্ন জায়গার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করেন। ইটভাটা ও মৎস্য ফিড ব্যবসায় বেশ সফলতা পান। তার উপার্জিত অর্থের একটি বিরাট অংশ দিয়ে খেলার মাঠসহ একটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয় দুটিতে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তিনি যেমন সনাতন ধর্মের মানুষদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বা মন্দিরে বিভিন্ন সহায়তা দেন ঠিক তেমনি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করে তাদেরকে উৎসাহিত করেন। অসম্প্রদায়িক চেতনার এরকম একজন মানুষ এলাকার জন্য সত্যিই অত্যন্ত সহায়ক।
প্রফুল্ল কুমার রায় বলেন, ‘জীবনের একটা সময় আমি অনেক কষ্টে পার করেছি। বারবার আমার পিতা বলতেন ‘যা ন্যায় ও সত্য তাই ধর্ম, যা অন্যায় ও অসত্য তাই অধর্ম। পরিশ্রমে আনে ধন, পূর্নে আনে সুখ।’ স্মৃস্টিকর্তা আমকে টাকা দিয়েছেন এবং মানুষের সেবা করার মনও দিয়েছেন। তাই তাই আমি আমার উপর্জনের অর্ধেক পয়সা মানুষ এবং সমাজের উন্নয়ন কাজে ব্যয় করি।’ প্রচার বিমুখ এই মানুষটি অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন পালন করেন। যার মধ্যে নেই কোন অহংকার। এটাই তার গর্ব।
Please follow and like us: