আয়াতুল কুরসিতে আল্লাহ তা’য়ালার ১০টি গুনাবলীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা-
১. اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ =
তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টজীবের তিনিই একমাত্র আল্লাহ। তিনি ছাড়া এই বিশ্বজগতে অন্য কোন মাবুদ, প্রভু বা ইবাদত পাওয়ার যোগ্য কেউ নেই। সমস্ত ইবাদত পাওয়ার যোগ্য একমাত্র তিনিই।
২. الْحَيُّ الْقَيُّومُ = তিনি চিরঞ্জীব ও চিরন্তন সত্তা যার উপর কখনও মৃত্যু আসবে না। যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহানের দায়িত্বভার বহন করছেন অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টজীব তার মুখাপেক্ষী, তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন। তিনি সর্বদা জীবিত; মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। (الْقَيُّومُ) শব্দ কেয়াম থেকে উৎপন্ন, এটা ব্যুৎপত্তিগত আধিক্যের অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ এই যে, তিনি নিজে বিদ্যমান থেকে অন্যকেও বিদ্যমান রাখেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। الْقَيُّومُ আল্লাহর এমন এক বিশেষ গুণবাচক নাম যাতে কোন সৃষ্টি অংশীদার হতে পারে না। তার সত্তা স্থায়ীত্বের জন্য কারো মুখাপেক্ষী নয়। কেননা, যে নিজের স্থায়ীত্ব ও অস্তিত্বের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী, সে অন্যের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ কি করে করবে? সে জন্যই কোন মানুষকে ‘কাইয়ূম বলা জায়েয নেয়। যারা আবদুল কাইয়ূম’ নামকে বিকৃত করে শুধু কাইয়ূম’বলে, তারা গোনাহগার হবে ।
৩. لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ = তিনি ঘুমান না এবং তন্দ্রাও তাঁকে স্পর্শ করে না। প্রত্যেকের কাজের উপর তার রয়েছে সজাগ দৃষ্টি, সকল অবস্থায় তিনি প্রত্যক্ষ করছেন। সৃষ্টজীবের কোন অনু-পরমানুও তার হেফাজত ও জ্ঞানের বাইরে নেই। ক্ষনীকের জন্যও তিনি সৃষ্টজীব থেকে উদাসীন থাকেন না। তৃতীয় বাক্য (আরবি) আরবীতে (আরবি) শব্দের সীন-এর (আরবি) দ্বারা উচ্চারণ করলে এর অর্থ হয়ে তন্দ্রা বা নিদ্রার প্রাথমিক প্রভাব (আরবি) পূর্ণ নিদ্রাকে বলা হয়। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা তন্দ্রা ও নিদ্রা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। পূর্ববর্তী বাক্যে ‘কাইয়ূম’ শব্দে মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আসমান ও যমীনের যাবতীয় বস্তুর নিয়ন্ত্রণকারী হচ্ছেন আল্লাহ্ তা’আলা। সমস্ত সৃষ্টিরাজি তার আশ্রয়েই বিদ্যমান। এতে করে হয়ত ধারণা হতে পারে যে, যে সত্তা এত বড় কার্য পরিচালনা করেছেন, তার কোন সময় ক্লান্তি আসতে পারে এবং কিছু সময় বিশ্রাম ও নিদ্রার জন্য থাকা দরকার। দ্বিতীয় বাক্য দ্বারা সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহকে নিজের বা অন্য কোন সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করবে না, নিজের মত মনে করবে না। তিনি সমকক্ষতা ও সকল তুলনার উর্ধ্বে। তার পরিপূর্ণ ক্ষমতার পক্ষে এসব কাজ করা কঠিন নয়। আবার তার ক্লান্তিরও কোন কারণ নেই। আর তার সত্তা যাবতীয় ক্লান্তি, তন্দ্রা ও নিদ্রার প্রভাব থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
৪. لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ = পৃথিবী ও আকাশে যা কিছু আছে সবই তাঁর। অর্থাৎ পৃথিবী ও আকাশের মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর তিনিই একমাত্র মালিক। গোটা বিশ্বজগতে তাঁর মালিকানা, কর্তৃত্ব ও শাসন পরিচালনায় কারো এক বিন্দু পরিমাণও অংশ নেই এবং বিশ্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে তার বিধানের বাইরে থাকারও কোন সুযোগ নেই৷ তাঁর পরে এই বিশ্ব-জগতের অন্য যে কোন সত্তার কথাই চিন্তা করা হোক না কেন সে অবশ্যই হবে এই বিশ্ব-জগতের একটি সৃষ্টি মাত্র ৷ আর বিশ্ব-জগতের যে কোন সৃষ্টিই হবে আল্লাহর মালিকানাধীন এবং তাঁর দাস ৷
৫. مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ = কে আছে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে ? যেহেতু আল্লাহ্ তা’আলা যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর মালিক এবং কোন বস্তু তার চাইতে বড় নয়, তাই কেউ তার কোন কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকারী নয়। তিনি যা কিছু করেন, তাতে কারো আপত্তি করার অধিকার নেই। বিধায় তার অনুমতি ছাড়া সে দিন কারো শুপারিশ করার অনুমতিও থাকতে পারে না। তবে কিছু মানুষেরা এমন ভাবতে পারে যে , কেউ কারো জন্য সুপারিশ করতে পারে, তাই এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, এ ক্ষমতাও কারো নেই। তবে আল্লাহর কিছু খাস বান্দা আছেন, যারা তার অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে পারবেন, অন্যথায় নয়। হাদীসে এরশাদ হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম আমি সুপারিশ করব। [মুসলিমঃ ১৯৩] একে মাকামে-মাহমুদ বলা হয়, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর জন্য খাস। অন্য কারো জন্য নয়।
৬. يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ = যা কিছু মানুষের সামনে আছে তা তিনি জানেন এবং যা কিছু তাদের অগোচরে আছে সে সম্পর্কে তিনি অবগত অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্বন্ধে জ্ঞাত। তাঁর জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টজীবকে ঘিরে তার জ্ঞানের বাহিরে কিছুই নেই।
৭. وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ =তিনি নিজে যে জিনিসের জ্ঞান মানুষকে দিতে চান, সেটুকু ছাড়া তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ব করতে পারে না। অর্থাৎ তিনি যতোটুকু জ্ঞান দিতে ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত মানুষ তার জ্ঞানের কোন বিষয়েই ধারণা করতে পারে না। মহান আল্লাহ্ যে অসীম জ্ঞানের মালিক তা থেকে তিনি যদি কাউকে জানানোর ইচ্ছা করেন তাহলে যতটুকু জানাতে ইচ্ছা করেন তিনি তাকে ততটুকু জানান। মহান আল্লাহ্ যাকে যে জ্ঞান বা প্রজ্ঞা দান করেন তার অধিক জ্ঞাত হওয়ার ক্ষমতা কারো নেই।
৮. وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ= তাঁর কর্তৃত্ব আকাশ ও পৃথিবী ব্যাপী। তার কুরসী এত বড় যার মধ্যে সাত আকাশ ও সাত যমীন পরিবেষ্টিত রয়েছে। হাদীসের বর্ণনা দ্বারা এতটুকু বোঝা যায় যে, কুরসী এত বড় যা সমগ্র আকাশ ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। ইবনে কাসীর আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর উদ্ধৃতিতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কুরসী কি এবং কেমন? তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম, কুরসীর সাথে সাত আসমানের তুলনা একটি বিরাট ময়দানে ফেলে দেয়া একটি আংটির মত। আর কুরসীর উপর আরশের শ্রেষ্ঠত্ব তেমন আংটির বিপরীতে বিরাট ময়দানের শ্রেষ্ঠত্ব যেমন । [ইবন হিব্বান: ৩৬১ বায়হাকী: ৪০৫]
৯. وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا = এগুলোর রক্ষণাবেক্ষন তাঁকে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত করে না। আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষে এ দুটি বৃহৎ সৃষ্টি, আসমান ও যমীনের হেফাজত করা কঠিন কোন কাজ নয়। কারণ, এই অসাধারণ ও একক পরিপূর্ণ সত্তার পক্ষে এ কাজটি সমাধা করা একান্তই সহজ।
১০. وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ = মূলত তিনিই এক মহান ও শ্রেষ্ঠ সত্তা পূর্বের নয়টি বাক্যে আল্লাহর সত্তা ও গুণের পূর্ণতা বর্ণনা করা হয়েছে। তা দেখার এবং বোঝার পর প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলতে বাধ্য হবে যে, সকল শান-শওকত, বড়ত্ব ও মহত্ব এবং শক্তির একমাত্র মালিক আল্লাহ সুবহানাহু অ-তা’আলা।