
রাজশাহীর নওহাটা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে একসময় নানা কসরত দেখিয়েছেন আলী আহম্মদ। তখন তার মাথাভর্তি ছিল লম্বা চুল। তাতে রশি বেঁধে মাঠের গোলপোস্টে ঝুলে থেকেছেন। চুলে রশি পেঁচিয়ে মাইক্রোবাসের সঙ্গে বেঁধে মাঠে টেনে বেড়িয়েছেন। চুলে ঢেঁকি বেঁধে শূন্যে ঘুরিয়েছেন।
আবার গর্ত খুঁড়ে তার ভেতরে ২৪ ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছেন। চূর্ণ কাচ ও জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হেঁটে গেছেন। বুকের ওপর দিয়ে গাড়ির চাকা তুলে পার করেছেন অনায়াসেই।
২০০৪ সালে তার অসাধারণ এসব ক্রীড়াশৈলী প্রচার হয় জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও খবরের শিরোনাম হন তিনি। এরপর সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে তার গুণের কথা। তারপর বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাক আসতে থাকে খেলা দেখানোর জন্য। এতে ভালোই কাটছিল তার দিন ও সংসার।
কিন্তু এ সবকিছুই এখন শুধুই স্মৃতি। কারণ হঠাৎ তার ভাগ্যে নেমে আসে দুর্দিন। একপর্যায়ে নিজের কিডনি বেচে সংসারের হাল ধরারও ঘোষণা দেন। ভাইরাল হওয়ার পর অনেকেই খোঁজখবর নিলেও দুঃসময়ে এখন আর কাউকে পাশে পান না।
‘চুলের জাদুকর’ আলী আহম্মদের বয়স এখন ষাটের ঘরে। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ। হাতে নেই কাজ। আয়-রোজগারও নেই। রাজশাহীর নওহাটা পৌর এলাকার বাঘহাটা এলাকার বাসিন্দা আলী আহম্মদের স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে এখন।
একসময় শিরোনাম হওয়া খবরের কাগজগুলো ও ছবির অ্যালবামগুলো যতেœ তুলে রাখলেও খেলা দেখিয়ে পাওয়া পুরস্কারগুলো ধরে রাখতে পারেননি। অভাবের তাড়নায় সেগুলো বিক্রি করে দেন। পালিত একটা ছাগল ছিল তার, যেটি লোকজনকে সালাম দেওয়ার কসরত জানত, অভাবের সংসারে সেটিও বিক্রি করে খেয়েছেন। আলী আহম্মদ জানান, তার মূল পেশা ছিল শিলপাটা কোটানো। হাতে কাজ না থাকলে এলাকায় ঘুরে ঘুরে শারীরিক কসরত দেখাতেন। ইত্যাদির দু’জন ক্যামেরা এসে এ মাঠেই তার শারীরিক কসরতের ভিডিও ধারণ করেন। পরে ইত্যাদিতে প্রচার হয় সেটি। আরও বিভিন্ন খবরের কাগজেও তাকে নিয়ে খবর প্রকাশ হয়। কিন্তু তার ভাগ্য ফেরেনি।
শিলপাটা কোটানোর পাশাপাশি খেলাধুলাও চালিয়ে গেছেন। কিন্তু সময়ের ফেরে কাজ হারিয়ে একেবারেই বেকার হয়ে পড়েন। ঘুরতে ঘুরতে একসময় পৌঁছে যান শাহমখদুম দরগায়। সেখানে থাকাকালে তার চুলে হঠাৎই জট পড়ে যায়। পরে জট ছাড়িয়েছিলেন। কিন্তু তারপর অজানা অসুখে আক্রান্ত হন। জট রাখার মানত করে রোগমুক্তি হলেও হারিয়ে ফেলেন আগের কর্মক্ষমতা।
কঠিন সময়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নওহাটা পৌরসভার তৎকালীন মেয়র আব্দুল গফুর সরকার। তাকে মাস্টাররোলে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নওহাটা পৌরসভায় নিয়োগ দেন মেয়র। দৈনিক ৫০ টাকা মজুরি পেতেন তিনি। সেখানে প্রায় ১০ বছর কাজ করেছেন।
কিন্তু সামান্য মজুরিতেও সংসার চালাতে পারছেন না। ভেবেছিলেন চাকরিটা স্থায়ী হবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। বছর তিনেক আগে ছাঁটাইয়ে পড়ে চাকরি চলে যায় তার। ফলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শুরু হয় মানবেতর জীবনযাপন। তাই বাধ্য হয়ে আবার শিলপাটা কোটানোর কাজে নামেন। করোনায় কাজ বন্ধ হলে হ্যান্ডমাইক নিয়ে করোনা সচেতনতার কাজ শুরু করেন। তাতেও পাননি সহায়তা। শেষে জানাজার ঘোষণায় নামেন।
চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়ে পেশা হিসেবে বেছে নেন শিলপাটা কোটানো। ওই সময় থেকেই তিনি শারীরিক কসরত দেখাতেন। তার ঘরে বউ হয়ে আসেন আঞ্জুয়ারা বেগম। কিন্তু টানাটানির সংসারে সুখের দেখা পাননি তিনি। পাঁচ বছর বয়সী প্রথম ছেলেসন্তান মারা যায় একরকম বিনা চিকিৎসায়। এরপর একে একে কোলজুড়ে আসে তিন মেয়ে আমেনা খাতুন, হালিমা খাতুন ও মদিনা খাতুন। বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। সন্তান জন্মের পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন বড় মেয়ে আমেনা। সেই থেকে বাপের বাড়িতে। বিনা চিকিৎসায় দিনে দিনে খারাপের দিতে যাচ্ছে তার অবস্থা।
পৌর এলাকার বাঘহাটায় আলী আহম্মদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শাকপাতা রান্না করছেন আঞ্জুয়ারা খাতুন। তিনি বলেন, স্বামীর আয় রোজগার নেই। প্রতিবেশীর কাছে থেকে চাল ধার করে এনে আজ রান্না করছেন। তবে কাল কী করবেন, জানেন না। স্বামীর আয় রোজগার নেই। কীই-বা করার আছে তাদের?
একবার চায়না একটি চ্যানেলের টিম এসে তার চুলের কেরামতির ভিডিও ধারণ করে। যাওয়ার সময় তারা তাকে ৫ হাজার টাকা দেয়। সেই টাকার ও স্থানীয়দের দান-সহায়তা নিয়ে কোনো রকমে মাত্র এক শতক জমির ওপরে দু’টি শোবার ঘরের ঠাঁই করেন আলী আহম্মদ।
তবে বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তা নেই। শৌচাগার নির্মাণ করবেন, সেই জায়গাও নেই। সরকারি সহায়তায় টিনের একটি ঘর পেলেও সেটি এখন থাকার অনুপযোগী। কোনো রকমে খাঁচার মতো পরিবার নিয় জীবন কাটাচ্ছেন আলী আহম্মদ। তার শেষ ইচ্ছে, জীবনের অনেক বাঁক পেরিয়ে এসে এখন যদি একটি ছোট দোকান দিতে পারতেন, তাহলে কাটিয়ে দিতেন বাকি জীবন।