কুড়িগ্রাম থেকে, রাশিদুল ইসলাম ঃ
কুড়িগ্রাম ট্রাফিক বিভাগে চলছে হজবরল অবস্থা। অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বছরে অবৈধ ভাবে শুধু ট্রাফিক বিভাগের আয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চলছে মোটর সাইকেলে জরিমানার নামে হয়রানি। যা একেবারে জুলুমের পর্যায়ে ঠেকেছে দরিদ্র জনপদের মানুষদের কাছে। আর এ সুযোগে প্রতি বছর এক কোটি ৪৪ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কুড়িগ্রামের ট্রাফিক বিভাগের ইন্সপেক্টর প্রশাসন ওয়াজ নবী এবং তার তৈরী বিশেষ টিম। তাঁর অপকর্মের অন্যতম সহযোগী টিএসআই আমিরুল ও এটিএসআই হারুন। ৫/৬জনের একটি বিশেষ টিম মাসের ২৩/২৪দিন বিভিন্ন উপজেলায় অভিযানের নামে শুধুমাত্র মোটর সাইকেল আটক করে। রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত (নাম্বার যুক্ত) গাড়িও আটক করা হয়। আর রেজিস্ট্রেশন না থাকলে তো কথাই নেই। সবার জরিমানা চার হাজার ৮০০ টাকা। দেশের সব চেয়ে দরিদ্রপীড়িত এ জেলার সাধারণ মানুষের সাশ্রয়ী বাহন মোটর সাইকেল। তারা অতি প্রয়োজনীয় এ বাহনটি নিয়ে বিপাকে পড়েছে। বছরে কয়েকবার গুণতে হয় জরিমানা। অথচ জরিমানর সিংগভাগ টাকা যায় টি আই ওয়াজ নবীর পকেটে। সরকার বঞ্চিত হয় রাজস্ব থেকে। ভিকেল এ্যাক্টের আওতায় পড়েনা এমন বাহন-ভটভটি, পাওয়ার টিলার, টলি, ব্যাটারি চালিত অটো, ব্যাটারি চালিত রিক্সা চলছে দেদারছে। অন্যান্য যানবাহন থেকে বছরে মাসহারা আসে সোয়া এক কোটি টাকা। কুড়িগ্রাম শহর এখন যানযটের শহরে পরিণত হয়েছে। যত্রতত্র পাকিং, এলোমেলো ভাবে রাস্তায় চলাচল করায় শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে চলে ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট। শহরের ব্যস্ততম সড়কে নেই ট্রাফিক বিভাগের চোখে পড়ার মত উদ্যোগ। ফলে ছোট-বড় দুর্ঘটনা লেগেই আছে। সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন যখন বিপর্যস্ত তখনও টি আই ওয়াজ নবীর বাহিনী দিন-রাত ব্যস্ত সময় কাটায় মোটর সাইকেলের মামলা আর জরিমানার টাকা ছয়নয় নিয়ে।
অফিস সুত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রাম ট্রাফিক বিভাগে লোকবল ৪১জন। এর মধ্যে টি আই (ট্রাফিক ইনেসপেক্টর) পদে ৫জন। এর মধ্যে ২জন ঢাকা হেড-কোয়াটারে সংযুক্ত অপর তিনজন এখানে কুড়িগ্রামে কর্মরত। সার্জেট ২জন, টিএসআই ৩জন, এটিএসআই ৯জন এবং কনস্টেবল ২২জন।
অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ সুত্রে জানা যায়, মোটর সাইকেল বাদে অন্যান্য যানবাহন থেকে মাসিক আয় প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ছয়শত ট্রাক ও ছোট ট্রাক থেকে ৬০০ হিসাবে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, দেড়শ’ দূরপাল্লার কোচ থেকে ৫০০ হিসাবে ৭৫ হাজার টাকা, ১৩৫টি মিনিবাসে ২০০ হিসাবে ২৭ হাজার টাকা, ২৯৩টি জেএস ও মহেন্দ্র ত্রি-হুইলার প্রতি ৩০০ হিসাবে ৮৭ হজোর ৯০০টাকা, ১১১টি মাইক্রোবাস ও কার প্রতি ২০০ হিসাবে ২২ হাজার ২০০ টাকা, ৪০০টি টলি প্রতি ৩০০ হিসাবে এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা, ট্রাক্টর প্রতি ৫০০ টাকা হিসাবে ২ লাখ টাকা মাসোহারা উত্তোলন করা হয়। এছাড়া অটো, ব্যাটারি চালিত রিক্সা, ভটভটি, নছিমন, করিমন এবং দেশের অন্যপ্রান্ত থেকে আসা অন্যান্য বাহন থেকে গড়ে আরো দেড় লাখ টাকা আয় হয়। সব মিলিয়ে বছরে আয় সোয়া এক কোটি টাকা।
অফিসিয়ালি সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও গড়ে প্রতিদিন ৩০/৩৫টি মামলা হয় মোটর সাইকেলের। বাড়ির উঠন থেকেও গাড়ি ধরে আনার রেকর্ড রয়েছে। নম্বর প্লেট থাকলেও সর্বোচ্চ জরিমানা গুনতে হয়। রাজনৈতিক তদবিরে অনেক ক্ষেত্রে টাকার অংক ৫০০/১০০০টাকা কমলেও বাকি টাকা রশিদ ছাড়াই গ্রহন করেন টি আই ওয়াজ নবী। অধিকাংশ মামলার জরিমানার টাকা তিনি পকেটস্থ করেন। আর সল্প পরিমান টাকা জমা হয় সরকারি কোষাগারে। এ হিসাবে মাসে তিনি শুধুমাত্র মোটর সাইকেলের মামলা সংক্রান্ত জরিমানা থেকে বাড়তি আয় করেন কম পক্ষে ১২ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছরে প্রায় এক কোটি ৪৪লাখ টাকার বাণিজ্য হয় মোটর সাইকেল মামলা সংক্রান্ত ক্ষাত থেকে। এ দুক্ষাত মিলে বছরে ট্রাফিক বিভাগের অবৈধ আয় দারায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
অভিযোগে জানা যায়, গত বছর ২২জুন রাজারহাটে ট্রাফিক পুলিশের এক টিএসআইয়ের ধাওয়া খেয়ে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে জয়নাল আবেদীন নামে এক কলেজ ছাত্রের মৃত্যু হয়। রাজারহাট-তিস্তা সড়কের মন্ডলের বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধ জনতা তিন ঘন্টা রাস্তা অবরোধ করে ট্রাফিক পুলিশের বিচার দাবি করে। পরে প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতারা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেয়া হয়। নিহত জয়নাল আবেদীন রাজারহাট ইউনিয়নের দেবীচরণ গ্রামের আব্দুল আউয়ালের ছেলে। সে রংপুর কারমাইকেল কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মাষ্টার্সের ছাত্র ছিল।
স্থানীয় লিয়াকত আলী বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ এখনও ওই স্পটে এসে গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষার নামে ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় এতো বাহন থাকলেও পুলিশের চোখ শুধু মোটর সাইকেলের উপর। এখন মনে হয় মোটর সাইকেলের মালিক মানে একজন পাপিষ্ট ব্যক্তি। রাস্তায় নামলেই অপদস্তের শিকার হতে হয়। অসৌজন্য আচরণ করেন তাঁরা। স্বাধীন দেশে নিজেকে খুবই পরাধিন মনে হয়।’
কুড়িগ্রাম শহরের খাদ্য ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, গত বছরে তাকে তিন দফা ট্রাফিক পুলিশের মামলায় পড়তে হয়েছে। প্রতিবারই ছিল ৪৮০০টাকার জরিমানা। তবে তদবির করে ২হাজার করে ৬হাজার টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছে। টাকা দেয়ার সময় মামলার লাল কাগজটি তারা নিয়ে নেন। তবে টাকার কোন রশিদ দেয়া হয় না।
শিক্ষক রনজু জানান, একদিন রাতে বাড়ি ফিরছিলাম। হালাবট নামক স্থানে কয়েকজন আকষ্মিক ভাবে লাইট জ্বালিয়ে মোটর সাইকেলের গতি রোধ করার চেষ্টা করছিল। আমি ডাকাত ভেবে দ্রুত গতিতে যাবার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের লাঠি চার্জে আমার একটি আঙ্গুল ফেটে যায়। পরে বুঝতে পারি তারা ট্রাফিক পুলিশ ছিল। অথচ আমার গাড়ির সকল কাগজপত্রই আছে।
এরপরও বড় অভিযোগ হলো গাড়ি আটক করে অতিরিক্ত টাকা আদায়। ভুরুঙ্গমারীর আবু সাইদের ‘এম সি’ কাগজ জব্দ করার পরও গাড়িটি থানায় আটক করা হয়। পরে সবমিলিয়ে দাবি করা হয় ৬ হাজার টাকা। ৫ হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়িয়ে আনতে হয়। একই রকম অভিযোগ চিলমারী প্রেস ক্লাবের সভাপতি নজরুল ইসলাম সাবু’র। এক সপ্তাহের ব্যবধানে একই গাড়িতে দুই বার মামলা দেয় পুলিশ। ৫ হাজার টাকা করে দাবি করলেও দু’দফায় ৩ হাজার টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয় টি আই ওয়াজ নবীকে। তবে টাকা নেয়ার রশিদ কাউকেই দেয়া হয় না।
কে এই টি আই ওয়াজ নবী
কুড়িগ্রামের ট্রাফিক বিভাগের ইনেসপেক্টর প্রশাসন ওয়াজ নবী এর আগে রংপুর, নীলফামারী ও গাইবান্ধায় চাকুরি করেন। তবে এসব কর্মস্থলে অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং যানবাহন থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজির লিখিত অভিযোগে শাস্তি মুলক বদলী হয়। সর্বশেষ রংপুর বিভাগীয় শহরে মাত্র আড়াই মাস কর্ম-জীবনে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে কুড়িগ্রামে বদলী হয়ে আসেন ২০১৬ সালের শেষ দিকে।
কুড়িগ্রামের ট্রাফিক বিভাগের ইনেসপেক্টর প্রশাসন ওয়াজ নবী তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অন্যান্য জেলায় যে ভাবে চলে এখানেও সে ভাবে চলছে। আর আমি তো একা নই যা করি সবাই মিলে করতে হয়। আমার তো অনেক স্টাফ।