
এহসান রায়হান- চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে তার সফর শেষ করে চলে গেছেন। ১৪ বিলিয়ন থেকে শুরু করে ৪০ বিলিয়ন পর্যন্ত বিনিয়োগের কথা শুনলাম। সেই বিনিয়োগ যে ঋণ, সেটা কেউ বললেন না। কোন কোন খাতে এই ঋণগুলো পাওয়া যাবে তার পূর্নাঙ্গ তালিকাও নেই। এমন কী এই ঋণে সুদের হার কত, তাও জানা গেল না। কাজেই এই সফর থেকে বাংলাদেশের জনগনের কতটুকু লাভ হয়েছে এখনো বুঝতে পারিনি। তবে জানা গেছে- এই ঋণের টাকায় বাংলাদেশে ধনী হলে তাতে ভারতেরও লাভ হবে। সেটা তো বটেই! বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ে মোট কর্মসংস্থানের একটা বড় অংশ দখল করে আছে ভারতীয় জনগোষ্টী, এই দেশ থেকে ভারতেই সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স যায়। আবার ভারতের শীর্ষ ফরেন রেমিটেন্স প্রেরণকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম। সুতরাং বাংলাদেশে বিনিয়োগ হলে তাতে ভারতে লাভ না হয়ে যাবে কোথায়? বিগত কয়েক বছরের মধ্যে যে কোন বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানের বাংলাদেশ সফরের মধ্যে এইবারই বিএনপি’কে যথাযথ মর্যাদায় এবং রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে সম্মানিত করেছেন চীনের সফররত প্রেসিডেন্ট। কোন সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়, টেবিলের এক প্রান্তে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং তাঁর দেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, অপর পাশে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দলের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। যেমনটা দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে হয়। সোজা কথায়, চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রটোকল দিয়ে তাঁর সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেছেন। বিষয়টি বিএনপি এবং বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। এই কুটনৈতিক সাফল্যের কৃতিত্ব অবশ্যই বিএনপির আন্তর্জাতিক কমিটির। আরো সুস্পষ্ট করে বললে চীনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা বিএনপির নেতৃবৃন্দের। কিন্তু চীনের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক বেগম খালেদা জিয়াকে এই সম্মান দেখানো অনেকেরই পছন্দ হয়নি, বিশেষ করে বিএনপি’র শত্রুদের কাছে তো এটি একটি গাত্রদাহের কারণ! এই ক্ষোভ এবং ঈর্ষা তারা কিভাবে প্রকাশ করবে? কিভাবে তারা এই বৈঠককে বিতর্কিত করবে? যে কোন একটা ছুতা দিয়ে এই বৈঠককে তো অবশ্যই বির্তকিত করতে হবে। সেই ছুতাটা এরা আবিষ্কার করেছে ঐ বৈঠকে অংশ নিতে না পারা বিএনপি নেতা এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী এ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের অংশগ্রহণ করা নিয়ে। চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে বিএনপির যে প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ করার কথা ছিল, সেখানে জনাব রিয়াজ রহমানের নাম ছিল। তিনি সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং ক্যারিয়ার ডিপ্লোমেট। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। সুতরাং তিনি বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেইদিন ঢাকা শহরে এক কৃত্তিম যানজট তৈরীর কারণে জনাব রিয়াজ রহমান যথা সময়ে বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেন নাই। প্রতিনিধিদলে একজন কম ছিল। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হয়েছে সেইখানে উপস্থিতদের মধ্য থেকেই। স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিতদের মধ্যে যিনি রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদায় সিনিয়র তিনি যোগ দিয়েছেন। সরকারপন্থী মিডিয়াগুলো লিখেছে- শিমুল বিশ্বাস বেগম খালেদা জিয়ার একজন ‘কর্মচারী’ এবং ‘ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী’ হয়ে কিভাবে এই বৈঠকে যোগ দিল। সেই সাথে তারা বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে লিখেছে- ‘শিমুল বিশ্বাস সরকারের এজেন্ট। বৈঠকের গোপন তথ্য সরকারের কাছে পৌছে দেবার জন্যই সে ঐ বৈঠকে অংশ নিয়েছে’! সরকারী মিডিয়া এইসব প্রচারণা চালাবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সমস্যা হচ্ছে, এইসব প্রচারণাকে যখন বিএনপিরই কিছু নেতা-কর্মী-সমর্থক দাবীদাররা বিকল্প মিডিয়ায় প্রচার করেন। শিমুল বিশ্বাস সচিবে মর্যাদায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) এর চেয়ারম্যান ছিলেন। উনার সচিব মর্যাদার বিষয়টি আমি জানি, কারণ আমি জেলে যাবার তিনদিন পর উনি জেলে গিয়েছিলেন এবং ঐ সচিব মর্যাদার কারণেই জেলে উনাকে ডিভিশন দেয়া হয়েছিল। ডিভিশন দেবার সেই অর্ডারটি আমি নিজ চোখে দেখেছি। একজন প্রক্তন সচিব মর্যাদার কর্মকর্তাকে যারা মামুলি ‘কর্মচারী’ হিসেবে বর্ননা করে, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবো, নাকি হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত করবো, সেটা বুঝতে পারছি না। হলুদ মিডিয়ার সবচেয়ে হাস্যকর প্রচারণাটা হচ্ছে- শিমুল বিশ্বাস সরকারের এজেন্ট এবং তিনি বৈঠকের সব গোপন কথা সরকারের কাছে ফাঁস করে দেবেন! খাসা যুক্তি! এরা নিজেরাই কিন্তু উল্লেখ করেছে যে, উনি ওয়ারেন্ট ভুক্ত আসামী! অর্থাৎ, সরকার বিএনপিতে তাদের এজেন্ট শিমুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ৪৭টি মামলা দিয়েছে যার মধ্যে আবার ১০টিতে ওয়ারেন্টও ইস্যু করে রেখেছে! এই গাঁজাখোরি যুক্তি বিশ্বাস করতে হলে কতটা নির্বোধ হতে হয়, সেটা ভাবছি। সবচেয়ে বড় কথা, চীন এবং বিএনপির মধ্যেকার বৈঠকটি তো কোন গোপন বা রুদ্ধদ্বার বৈঠক ছিল না, সেটি একটি প্রকাশ্য বৈঠক ছিল। এমন বৈঠকে আলোচিত বিষয় সম্পর্কে সবাই জানে, সেটি আবার ফাঁস করতে হবে কেন? ২০১০ এবং ২০১২ সালে বেগম খালেদা জিয়া যখন চীন সফর করেছিলেন, তখন চীনের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে যে সৌজন্য সাক্ষাৎকার এবং দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার দুইটি ছবি আমি এখানে দিচ্ছি। দুইটি ছবিতেই শিমুল বিশ্বাসকে দেখা যাচ্ছে। সেই সময় কিন্তু ঐ বৈঠকগুলোতে তার উপস্থিতি নিয়ে কোন সমালোচনা হয়নি। তাহলে এখন কেন সমালোচনা? বোঝা যাচ্ছে- বেগম খালেদা জিয়ার সাথে শি চিনপিং এর রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে দ্বিপাক্ষিক বৈঠককে বিতর্কিত করাই এই সমালোচনার মূল উদ্দেশ্য। অন্য কিছু নয়। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী পদটি কোন ‘কর্মচারী’ পদ নয়, এটি একটি সচিব পদমর্যাদার রাজনৈতিক পদ। সেই পদে কে নিযুক্ত হবেন, সেটি নির্ধারণ করবেন স্বয়ং চেয়ারপার্সন। তিনি যাকে যোগ্য মনে করবেন এবং যাকে দিয়ে কাজ করাতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন, তাকেই তিনি নিয়োগ দেবেন। উনার বিশেষ সহকারী পদে কারো নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে চিন্তা করুন- আপনার কারখানায় আপনি কাকে ম্যানেজার নিয়োগ করবেন, সেটি নিয়ে অন্যরা, বিশেষ করে আপনার শত্রুরা প্রশ্ন তুললে তা আপনি কিভাবে নিবেন??