চলতি বছরজুড়ে সপ্তাহের প্রায় প্রতিটি কার্য দিবসেই আদালতে ব্যস্ত থাকতে হবে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে। জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুইটি মামলার বিচার কাজ সমাপ্তি পর্যায়ে আসার পর আরো ১৪টি মামলা শুনানির জন্য স্থানান্তর করা হয়েছে রাজধানীর বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে।
আইনজীবীরা বলছেন, এই মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম শিগগিরই বিশেষ আদালতে শুরু হলে কার্যত সপ্তাহজুড়েই মামলা ও বিচার সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। কারণ এই বিশেষ আদালতও ব্যস্ত থাকবে খালেদা জিয়ার মামলাগুলোর বিচার কাজ নিয়ে। এ সপ্তাহে গত সোমবার থেকে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতিদিন আদালতে হাজিরার দিন পড়ে। মঙ্গলবার বিশেষ আদালতে যান খালেদা জিয়া। বুধবারও যাবেন। আগামী রবিবারও আদালতে হাজিরার দিন আছে। গত সপ্তাহেও তিনদিন আদালতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। রবিবার আদালতে হাজিরা দেয়ার পূর্ব নির্ধারিত তারিখ থাকলেও তিনি যাননি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সপ্তাহে অন্তত দুই-তিন দিন তাকে এই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে বেশ কিছু দিন ধরে।
এপ্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন আবারও একতরফা করতে যড়যন্ত্র ও অপচেষ্টার অংশ হিসাবে খালেদা জিয়ার আরও ১৪ মামলা বকশীবাজারে স্থানান্তর করা হয়েছে। নতুন মামলাগুলো বকশীবাজারে স্থানান্তরের উদ্দেশ্য হল তাকে প্রতিনিয়ত হয়রানির মধ্যে রাখা এবং অবিরামভাবে হেনস্তা করা। এটা কারো বুঝতে বাকি নেই যে, বছরজুড়ে উনাকে আদালতে ব্যস্ত রেখে আন্দোলন ও নির্বাচনী জনসংযোগ থেকে বিরত রাখার চক্রান্ত করছে সরকার। চেয়ারপারসনকে নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ কারণেই প্রতি সপ্তাহেই অন্তত দুই-তিনবার আদালতে হাজিরা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। তবে এসব করে শেষ পরিনতি সরকারের জন্য ভালো হবে না।
তবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বিএনপির এ অভিযোগ নাকচ করে বলেছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে বেগম খালেদা জিয়ার মামলাগুলো ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এতে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দেয়ার সময় অনেক লোকজন থাকে। সঙ্গে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীও থাকে। এতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এসব বিষয় বিবেচনা করে নিরাপত্তার স্বার্থে ওই আদালতে মামলাগুলো স্থানান্তর করা হয়েছে।
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্দেশেই এই স্থানান্তর কিনা জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, মামলা আইন অনুযায়ী তার নিজস্ব গতিতে চলবে। দ্রুত নিষ্পত্তি করা বা দ্রুত খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া সরকারের লক্ষ্য নয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই সরকারের লক্ষ্য এবং বিচার বিভাগে সরকার কখনো কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করে না।
এদিকে মামলা স্থানান্তর ও শুনানি দ্রুততর করার কারণে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ ও শংকা দেখা দিয়েছে। এনিয়ে আইনজীবী এবং দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন বেগম জিয়া।
বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে রবিবার রাতে গুলশানে দলের কার্যালয়ে এক বৈঠকেও এই প্রসঙ্গে আলোচনা প্রাধান্য পায়। কয়েকজন বুদ্ধিজীবী খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দেন যে, বিশেষ আদালতে স্থানান্তরিত ১৪টি মামলা নিয়মিত আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আইনী লড়াই করতে। ব্যবস্থা করা। তারা বলেন, বিশেষ আদালতে মামলাগুলো নেয়ার কারণ হচ্ছে আপনাকে (খালেদা জিয়াকে) প্রতিদিন আদালতে ব্যস্ত রাখা কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড- কার্যক্রমে অংশ নিতে না দেয়া।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠঅতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বেগম জিয়াকে বলেন, এটা আপনাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার সরকারী কৌশল। প্রতিদিন আপনাকে আদালতের বারান্দায় আটকে রাখার একটি ব্যবস্থা। তিনি আদালতে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলেও ঢাকার বাইরে সফরে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
বেগম জিয়ার একজন আইনজীবী জানান, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ৩৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ওয়ান-ইলেভেনে সেনাশাসিত সরকারের সময়ে দায়ের করা হয়েছে ৪টি মামলা। বাকিগুলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের দুই মেয়াদে করা। যে ১৪টি মামলা স্থানান্তর করা হচ্ছে তার মধ্যে ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতে ৯টি, বিশেষ জজ আদালতে ৩টি ও ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
গত ৮ জানুয়ারী ১৪টি মামলা বিচারের জন্য আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিশেষ এজলাসে স্থানান্তর করে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এই প্রজ্ঞাপনে সাক্ষর করেন আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-২ এ বিচারাধীন শাহবাগ থানার ৫৩(২)০৮ মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিশেষ এজলাসে স্থানান্তর করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মামলাটি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে পরিচালিত হলেও ভবনটিতে আরো অসংখ্য মামলার কাজ চলে। ফলে জনাকীর্ণ এই ভবনে নিরাপত্তাজনিত কারণে খালেদা জিয়ার মামলাটি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। একই কারণ দেখিয়ে তেজগাঁও থানার ২০(১২)০৭ নম্বর, ৫(৯)০৭ নম্বর, ১৫(০৮)১১ নম্বর এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা রমনা থানার ৮(৭)০৮ নম্বর মামলার কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা দারুস সালাম থানার ৬২(১)১৫ নম্বর, ৩(৩)১৫ নম্বর, ৮(২)১৫ নম্বর, ৫(২)১৫, ৬(২)১৫, ৩১(২)১৫, ১২(২)১৫, ২৯(২)১৫ এবং যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা বিশেষ মামলা ৫৯(১)১৫ বিশেষ এজলাসে স্থানান্তর করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়, মহানগর হাকিম আদালত নম্বর-৭ এ বিচারাধীন পিটিশন মামলা ১০৯৬/১৬ এবং ১১০/১৫-এর বিচারকাজ এত দিন মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ভবনে চলছিল। এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মামলা দুটির কার্যক্রম বিশেষ আদালতে স্থানান্তর করা হলো।
মূলত: মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে দারুস সালামের নাশকতার আট মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা, যাত্রাবাড়ী থানার বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা ও মানহানির দুই মামলা।
এদিকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক ১৪টি মামলার এই স্থানান্তর প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির বহি:প্রকাশ। ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে বিচার কাজ সুপারসনিক গতিতে’ পরিচালনা করার গভীর নীল নকশার ষড়যন্ত্র। বিচার কার্যক্রমকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে। আমরা মনে করি, আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেগম জিয়াকে আরো বেশি হয়রানি করতে সরকারের এটি নির্মম পদক্ষেপ।
Please follow and like us: