
মেহেদী হাসান,খুলনা থেকেঃ-
মহানগরীতে অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বরং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়েই সাজিয়ে বসেছেন হাসপাতাল। মহানগরীতে ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার ১৪২টি। এর মধ্যে ৯টির লাইসেন্স নেই। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের পাশাপাশি ওই সব সেন্টারে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। ফাঁদে পড়ে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে রোগীরা। মহানগরীতে অবস্থিত কয়েকটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরেজমিনে গেলে এ চিত্র পাওয়া যায়।
খুলনা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে গত ২০ অক্টোবর পর্যন্ত মহানগরীতে অবস্থিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রয়েছে ১৪২টি। এর মধ্যে ৭৭টি ক্লিনিকের মধ্যে ৪টি ক্লিনিক ও ৬৫টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে ৫টি সেন্টারের লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স না পাওয়া ক্লিনিকের মধ্যে রয়েছে নগরীর ১১নং ভৈরব স্ট্রান্ড রোডে অবস্থিত ডাঃ আমান উল্লাহ ক্লিনিক ও মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, খালিশপুরে নগর মাতৃ সদন কেন্দ্র, ৩১, রায়পাড়া রোডে নগর মাতৃ সদন কেন্দ্র ও নিরালা আবাসিক এলাকায় নিরালা ক্লিনিক।
স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা যায়, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের জন্য পৃথকভাবে অনুমোদন নেওয়া লাগবে। না নিলে ওই প্রতিষ্ঠানটি অবৈধ।
গতকাল সকাল ১০টার দিকে নগরীর সদর হাসপাতালের পেছনে ১১নং ভৈরব স্ট্রান্ড রোডে অবস্থিত ডাঃ আমান উল্লাহ ক্লিনিক ও মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে দেখা গেছে নোংরা পরিবেশ। ক্লিনিকের অনুমোদন তো নেই, সেই সাথে মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টারও খুলে বসেছেন। ওই ক্লিনিকে রিসিপশনে একজনের সাথে পরিচয় গোপন রেখে কথা বলে জানা গেছে, এখানে ডিজিটাল এক্সরে হয় না, নরমাল বুকের এক্সরে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা নেওয়া হয়। পাশে দেখা গেছে, রোগীর আনাগোনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোগীর আত্মীয় জানান, তার নাতনীকে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসার জন্য। অল্প খরচে অ্যাপেন্ডিসাইডিস অপারেশনে তার লাগছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে ক্লিনিকে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। একটু ভেতরে ডিউটি ডাক্তারের রুম। ওখানেই ভর্তি রয়েছে এক রোগী। দিনে সর্বক্ষণ ইলেকট্রিক লাইট জ্বালানো থাকে। বিদ্যুৎ হঠাৎ করে চলে গেলে দিনের বেলায় মনে হবে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটু সামনে গিয়ে দেখা যায়, মেঝেয় বসে কোন রোগীর আত্মীয় খাবার খাচ্ছেন। কোনটা নার্স আর কোনটা রোগী বোঝা মুসকিল। নার্সদের নেই ইউনিফরম। সাদা বিছানা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না করার করার কারণে কালো ও ময়লা দাগ পড়ে আছে। ওখানে বেশির ভাগ রোগী রূপসা নদীর ওপার, মোল্লাহাট ও খুলনার বিভিন্ন উপজেলার আশপাশ গ্রামাঞ্চলের। এক্সরে রুমে দেখা গেছে ময়লা ভর্তি।
বেলা দেড়টার দিকে নগরীর ৫৯, ১ সামসুর রহমান রোডে স্কুল হেলথ ক্লিনিকের সামনে বাংলাদেশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরিচয় গোপন রেখে জানতে চাওয়া হয়, এখানে কী শুধু টেস্ট হয়। রিসিপশনের এক মহিলা জানান, শুধু টেস্ট না, রোগীও দেখা হয়। মেডিসন বিশেষজ্ঞ আছেন, বিকেলে বসবেন। তার প্রতিষ্ঠানের একটি ভিজিটিং কার্ড দেওয়া হয়। বিকেল ৪টা ৪৮ মিনিটে ওই সেন্টারে মোবাইল ফোন করা হলে লিজা পরিচয়দানকারী বলেন, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ দেখালে ৬শ’ টাকা লাগবে। কোন সিরিয়াল লাগবে না। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ জাহিদুর রহমানকে দিয়ে দেখিয়ে দেবেন। বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টা তিনি রোগী দেখেন।
এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিজস্ব মহিলা টিম জেনারেল হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আনেন এবং বিভিন্ন টেস্ট ও ডাক্তার দেখিয়ে দেন। অনেক সময় তারা রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহারও করেন। এছাড়া আহসান আহমেদ রোডে লাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেতু ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এস,এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা হাসপাতাল থেকে অসহায় দরিদ্র রোগীদের ভাল টেস্ট ও বড় ডাক্তার, কম টাকায় দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলে ভাগিয়ে আনেন। এই সব দালালদের সাথে হাসপাতালে ফ্রি সার্ভিস হিসেবে কর্মরতদের যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া জেনারেল হাসপাতালে জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফারজানা রহমানের বিরুদ্ধে রোগ নির্ণয়ের নামে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। র্যায়ল ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন লিঃ ও আহসান আহমেদ রোডে লাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্লিপে ডাঃ ফারজানা রহমানের নাম রয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের একটি টোকেনে ডাঃ ফারজানা রহমানে নাম উল্লেখ করা একটি স্লিপও পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফারজানা রহমানকে ৫টা ৩৯ মিনিটে মোবাইল ফোনে একাধিক ফোন দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিচতলায় অবস্থিত নূর অর্থোপেডিক ক্লিনিকে বেলা পৌনে ২টায় দেখা গেছে, বাইরে অনেক রোগী একটি বেঞ্চে বসা রয়েছেন। রিসিপশনের একটু সামনে গিয়ে দেখা গেছে দুইটা বেড জুড়ে বসে আছেন রোগীর ৬/৭ জন। একটি বেডের ওপর রডের সাথে ৩টি ব্যান্ডেজের মতো কাপড় ঝুলে আছে। তার একটু ভেতরে রয়েছে আরও দুইটি বেড। এক রোগীর মাঝায় হিট দিতে দেখা যায়। মেঝেতে ধূলা-বালি। বাথরুম থেকে আসছে প্রস্রাবের গন্ধ। বাইরে দড়িতে যত্রতত্রভাবে টানানো রয়েছে রোগীদের বিছানার চাদর। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে চিকিৎসা সেবা। ১০, খানজাহান আলী রোডে লাইফ লাইন ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড থাইরয়েড সেন্টারে শুধু হরমোন টেস্ট করা হয়। কার্ডে উল্লিখিত ঠিকানা থাকলেও সেই স্থানে নেই প্রতিষ্ঠান। মোবাইল চুক্তির মাধ্যমে রোগীদের হরমোন টেস্ট করা হচ্ছে। নেই স্বাস্থ্য বিভাগের কোন অনুমোদন।
ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পরিচয়দানকারী সঞ্জয় রায়কে পরিচয় গোপন রেখে মোবাইল ফোন করলে তিনি বলেন, আপনি সামেলা ক্লিনিকে দাঁড়ান আমি আসতেছি। ৫ মিনিটের মধ্যে তিনি হাজির হন। সঞ্জয় বলেন, আপনার রোগী কোথায়, কি টেস্ট ? আমরা শুধু হরমোন টেস্ট করাই ৭০০ টাকা লাগবে। এই বলে তার প্রতিষ্ঠানের একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে দেন।
জানা গেছে, ওই একই প্রতিষ্ঠানের বিপুল সাহা ও সঞ্জয় রায় দুই জন মিলে গোপনে তাদের ওই প্রতিষ্ঠানে হরমোন টেস্ট করান। আগে বিপুল একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কর্মরত ছিল। পরবর্তীতে নিজেই ওই ডায়াগনস্টিক খুলে বসেন। ওই ঠিকানা অনুযায়ী গেলে কেউ লাইফ লাইন ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড থাইরয়েড সেন্টারের অবস্থান বলতে পারেনি। তবে ওই রোডে কোন একটি পুরাতন বিল্ডিংয়ে তাদের এই প্রতিষ্ঠানটি গোপনে ব্যবসা করছে। পরবর্তীতে সঞ্জয়কে মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সটকে পরেন।
জানা গেছে, ডাক্তারদের মাধ্যমে কোন রোগী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসলে ওই ডাক্তারের জন্য আল্ট্রাসনোর জন্য ৬০%, ইসিজি ৫০%, এক্সরের জন্য ২৫%, প্যাথলজি ৫০% কমিশন পেয়ে থাকেন। পাশাপাশি তাদের সাথে মাসিক একটি মাসোহারা চুক্তি রয়েছে।
খুলনা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, সরকারি নীতিমালায় একটি ১০ শয্যার ক্লিনিক পরিচালনায় ৩ জন এমবিবিএস ডাক্তার, ৬ জন ডিপ্লোমা নার্স, ৬ জন আয়া এবং ৩ জন সুইপার নিয়োগের বিধান রয়েছে। কিন্তু ক্লিনিক পরিচালনায় সরকারি নীতিমালা বিভিন্ন অজুহাতে মানছেন না প্রভাবশালী মালিক।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বিধি অনুযায়ী প্রতিটি ক্লিনিক ও হাসপাতালে একজন রোগীর জন্য ৮০ বর্গফুট জায়গা, ১০ বেডের জন্য তিনজন চিকিৎসক ও ছয়জন প্রশিক্ষিত নার্স এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অপারেশন থিয়েটার ও জেনারেটর থাকা বাধ্যতামূলক। এগুলো পরিদর্শনের জন্য একটি কমিটি রয়েছে। সরেজমিনে নগরী ও জেলার অর্ধডজনের বেশি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে দেখা গেছে, এই নিয়মের ধারে কাছেও নেই প্রতিষ্ঠানগুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, খুলনার আনাচে-কানাচে কয়েকশ’ বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও হাতে গোনা দুই-তিনটি ছাড়া বাকিগুলোতে বিধি কার্যকর নেই। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলেই রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়।
খুলনার সিভিল সার্জন এএসএম আঃ রাজ্জাক বলেন, মহানগরীতে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন দেন স্বাস্থ্য বিভাগ। তার পরেও যদি কোন ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন না নিয়ে চালিয়ে যান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। খুলনা জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফারজানা রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা ঠিক না, অমানবিক বিষয়। আপনি অভিযোগ পেয়েছেন, আমি এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।