গতবছরের কোনও এক সময় হিড়িক পড়ে গেল পত্রিকায় নিয়মিত বিচ্ছেদ সংবাদের। শুরুটা তাহসান মিথিলা দম্পতি শেষটা অপু বিশ্বাস- শাকিব খান। আরেক খবর রীতিমত তামাশার খোরাক জুটিয়েছে, ঢাবির একজন মহিলা প্রভাষককে একজন ঊর্ধ্বতন শিক্ষকের কক্ষে পেয়ে তালাবদ্ধ করে রেখে গেছেন ঊর্ধ্বতনের স্ত্রী। জের হিসেবে সেই মহিলা প্রভাষককে চলমান শিক্ষাবর্ষ থেকে অব্যাহ্তি দেয়া হয়েছে।
বিচারের ভুল ত্রুটির হিসেবের বাইরের এক হিসাবেও নজরে এলো, বর্তমানে রাজধানীতে বা সারাদেশে একক মায়ের সংখ্যা কতটা বেড়ে গেছে। প্রতিবেদনে জানলাম যে ডিভোর্স ফাইল করেছেন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী। বহুল আলোচিত এখনের দ্রুত পরিবর্তনশীল, ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক- যা বিয়ের প্রতিশ্রুতির অনেক আগে আবেগীয় সম্পর্ক থেকেই শুরু। অনেক বন্ধু পরিজন আর এই প্রজন্মের কাছ থেকে প্রায়ই “কি করে ভুলি তারে?” জাতীয় হাহাকার শুনি।
‘গুণঃ এতকিছুর পরেও যাকে ভুলতে পারেননি, তাকে ক্ষমা করুন। আর সবার আগে নিজেকে ক্ষমা করুন। কারণ নিজের ওপর রাগ বা হতাশা সর্বগ্রাসী। যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝান সেই মুহূর্তে এটাই দুজনের করণীয় ছিল। গ্লানি উৎরাতে না পারলে, নিজেকেই দোষী মনে হলে দুঃখ প্রকাশ করুন।’
যুগের এগিয়ে যাওয়ার ভালো মন্দের সাথে যে ভালোটা বলব তা হলো এখন এমন মানসিক সমস্যাকে অনেক আমল দেয়া হয়, যেটা খুবই যুক্তিযুক্ত। মন ভেঙে যাওয়া মানুষকে পরামর্শ দিতে গিয়ে কিছু পড়াশোনা হলো। নিজের জানা আর ধারের জানাটা সংক্ষেপে তুলে ধরছি-
১। সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলাঃ সাধারণভাবে একই স্থানে, যেমন বাজার, বিল, অফিস বা পড়ালেখার বা ঘুরাঘুরির স্থানে যাবার বিষয়ে নিজের সময় পাল্টে নিন ।
অফিসের সহকর্মী, ইউনিভার্সিটির ব্যাচমেট হলে এড়ানো সবচেয়ে দুঃসাধ্য। মিডিয়ার মত হুট করে “ এখন আমরা ভাই বোন / ভালো বন্ধু ” বাস্তবে হওয়া যায় না। বরং বার বার এসব বলাটাই প্রমাণ দেয় আপনি তাকে কতটা স্মরণ করছেন । তাই অফিস পাল্টানো, নিদেনপক্ষে ডিপার্টমেন্ট পাল্টানো বা শিক্ষার্থীদের ব্যাচ বা গ্রুপ পাল্টানোই স্বস্তিকর ।
আরেক অস্বস্তি, বন্ধু বা কোন মহলের কমন দাওয়াতি হলে। আগে থেকে আশঙ্কা হলে নিমন্ত্রণকারীকে সুন্দর করে জানাবেন তাঁর দাওয়াতের আবহাওয়া গুমোট না করতে এবং নিজেরও ব্যস্ত জীবনের সুন্দর সামাজিক মুহূর্তটা নষ্ট না করতে আপনি তার সাক্ষাৎ এড়াতে চান। সিদ্ধান্ত নিমন্ত্রণকারীর, তিনি কাকে প্রাধান্য দেবেন।
২। প্রযুক্তির জীবন থেকে মুছে ফেলুনঃ আজকের দিনে লোকের বাস্তবের চেয়ে ভার্চুয়ালিই সাক্ষাৎ হয় বেশি। তাই সকল ভার্চুয়াল বা প্রযুক্তির মাধ্যম থেকে মুছে ফেলুনঃ ফেসবুক, টুইটার , ইন্সটাগ্রামে ব্লক। ফোন নম্বর মুছে ফেলুন যেন ব্লক করে আবার আবার আনব্লক করতে পারার সুযোগ না থাকে। তার সব মেইল মুছে সম্ভব হলে ইমেইল এড্রেস নতুন বানিয়ে নিন।
প্রথমে দুঃসহ কষ্ট হলেও কদিন পরেই সব সয়ে যাবে। একবারে না পারলে ধাপে ধাপে, কারণ অনেক ক্ষেত্রে বেশি জোর করতে গেলে, হুট করে সব করলে হিতে বিপরীত হয়। ধুম করে তাকে ব্লক করে বা নিজের ফেসবুক ডিএক্টিভ করে আবারো ফেইক একাউন্ট খুলে তাকে দেখা আসলে নিজেকেই চিট করা।
৩। আপডেটঃ তার কোন আপডেট যেন নিয়মিত কোন বন্ধু হালনাগাদ না দেয় বিশেষ নজর দেবেন। অনেক বন্ধুই(!) নিজে যেচেই এই অপকারটা করে। অনেকে নিজেই সম্পর্ক ভেঙে গেলেও তার হালনাগাদে অন্যদের বিরক্ত করেন। মনে মনে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করতে না পারলে বলুন। কিন্তু সময় হিসেব করে দিনে দিনে কমান। তবে অন্যকে বলে নিজেকে ছোট করবেন না। তার নামে কুৎসা রটনাও প্রমাণ করে আপনি তাকে ছাড়া কত খারাপ আছেন, যে, যে কোন উছিলায় তার কথা না তুলে পারেন না।
৪। স্মৃতি বিস্মৃতিঃ তার স্মৃতি বিজড়িত জিনিস যতটা সম্ভব ফেলে দিন। না পারলে একদম চক্ষুর অন্তরালে সরিয়ে ফেলুন। সর্বক্ষণ দেবদাস হয়ে বিরহ বেদনার গান কবিতায় ডুববেন না। যন্ত্রণার একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। অপারেশন হয়েছে, পেথিড্রিন নিলে ব্যথা অনুভূত হবেনা- নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ড্রাগ কেটে গেলে ব্যথা ফিরে আসবেই। আর মনের ব্যথার এমন দাওয়াই নাই।
নেশা করে ভুলতে চাইলে নেশার রাত শেষে সকাল সেই বেদনাই ফিরে আসবে, উপরন্তু যোগ দেবে হ্যাং ওভার, মাথার যন্ত্রণা। যদি দেখেন সারাদিনের ধকল শেষে তাকে একআধটু মনে করতে ইচ্ছা করছে, করবেন। শেক্সপিয়ারের নাটক জনপ্রিয় ছিলই নাটকের বেদনা লোকের অব্যক্ত বেদনা জাগিয়ে দিয়ে কান্নায় কাটাকাটি খেলবার জন্য। কাজেই জ্বর হলে সাড়তে সময় নেবেই, সেই সময়ের য্ন্ত্রণা সহ্য করতেই হবে।
৫। প্রতিশোধে স্মরণ নয়ঃ নিজেকে সহী মনে হলে, আস্তিক হলে ভাবুন সে তার প্রতিশোধ বা বিচার পেয়ে যাবে। আবার যদি সে শোধ পেলেও আপনার কষ্ট, তাহলে ধর্মবিশ্বাসেই ভাবুন যা ঘটে তা ভালোর জন্যই ঘটে। কার্যকারণ ছাড়া কিছুই ঘটে না। কবি জর্জ হার্বার্টের পুরাতন লাইন “ বেঁচে থাকাই সর্বোত্তম প্রতিশোধ”। যে চলে গেছে , আপনি নিয়মিত তাকে স্মরণ করে করুণা পাবেন, তার আত্মগরিমা বাড়াবেন; তাকেও পাবেন না, তার শ্রদ্ধা ভালোবাসাও না। আপনি ভালো থেকে আপন শক্তিতে প্রমাণ করুন আপনি অক্ষম অযোগ্য কখনোই ছিলেন না।
৬। অনুভূতিগুলির প্রকাশ অন্যভাবে করুনঃ তাকে না লিখে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, তো অযথা কষ্ট না নিয়ে সেগুলি লিখে ফেলুন। কিন্তু, নিজের কাছে রেখে দিন। আগেরদিনে ডায়েরি লেখার মত। কাগজে লিখে পুড়িয়ে ফেলার মত। আবার ইচ্ছে হলে আগে পড়ুন, নতুন কিছু লিখতে চাইলে বা আবারও লিখতে চাইলে লিখুন। এভাবে লেখা একসময় ফুরিয়ে যাবে। ফোনে কথা বলতে ইচ্ছা হলে ভয়েস রেকর্ডারে নিজেই দুইপক্ষের কথা বলে রেকর্ড করুন। কথাও ফুরিয়ে যাবে।
৭। নিজেকে মূল্যায়ন করুনঃ নিজেকে নিজে মূল্যায়ন না করলে অন্য কেউই মূল্যায়ন করবে না। অহংকার সর্বনাশা; কিন্তু নিজের ভালোটা, প্রতিভাটা জানা কর্তব্য। প্রতিদিন খাতায় লিখুন বা মনে করুন আপনি কেন অনন্য, কিসে আপনি ভালো এবং সেটার কতটা অর্জন হয়েছে কতটা বাকি সেটা অনুসরণ করুন।
৮। ক্ষমা মহৎ গুণঃ এতকিছুর পরেও যাকে ভুলতে পারেননি, তাকে ক্ষমা করুন। আর সবার আগে নিজেকে ক্ষমা করুন। কারণ নিজের ওপর রাগ বা হতাশা সর্বগ্রাসী। যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝান সেই মুহূর্তে এটাই দুজনের করণীয় ছিল। গ্লানি উৎরাতে না পারলে, নিজেকেই দোষী মনে হলে দুঃখ প্রকাশ করুন। কোন আশা নিয়ে না, নিজেকে বাঁচাতে, নিজেকে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিতে। হোক সে অন্যের সাথে বা নিজের জীবনে এখন সুখি; তাকে ফিরিয়ে আনার আশায় না, নিজেকে ফিরে পাবার আশায় দুঃখপ্রকাশ করুন।
এবার “ নতুন আমি”কে নিয়ে এগিয়ে যান। তবে, নিজের সাথে অসততা করবেন না। নিজের মন কি চায় জানুন। বিশ্বস্ত কাউকে বলে হালকা হতেই পারেন। কিন্ত নিজের মতো খেদ নিয়েই দিন কাটাবেন জেনেও স্রেফ পরামর্শ চাইবার ভান করে তার মূল্যবান সময় নিলে আরও একজন ভালো বন্ধু হারাবেন। তাই আসলেই নিজে কি চাইছেন জানুন। কাউকে বেশি ভালবাসলে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। কিন্তু মানুষ এমন ভালো তাকেই বাসে যাকে পেলে তার জীবন পূর্ণ হতো মনে হয়। না পেলে শূন্য বলে মনে হয়। তাই ভালোবাসার দোষ দেবেন না, নিজের দোষও দেবেন না। সেটা সেই সময়ের দাবি ছিল। মানুষটা ভুল হলে বা নিজ ভুলে তাকে একেবারেই হারিয়ে ফেললে, যেই ভালোবাসার জন্ম হয়েছিল নিজেকে পূর্ণ করতে, সেই ভালোবাসা নিয়েই অন্য কিছুকে বা কাউকে সময়ের হিসেবেই পেয়ে যাবেন। তাই, জীবন ফুরাবার আগে ফুরাবেন না।
লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।