বাঁশের প্রচলন যা বাড়ছে, একজন আরেকজনকে বাঁশথেরাপি দিতে পারলে নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে। আর রডের জায়গায় বাঁশ ব্যবহার করে সারা বিশ্বে যুগান্তকারী বিল্পব ঘটিয়ে দিচ্ছে আমাদের দেশ। বাঁশের আসলে যথার্থ ব্যবহার হয় প্রবাস শব্দের স্থলে। বিস্তারিত বললে নানা প্রসঙ্গ টানা যায়, কিন্তু এখানে সামান্য অংশের বর্ণনায় প্রবাসের নাম ‘প্র-বাঁশ’ যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করছি।
যদি ভাবেন প্রবাসী বলে কোটিপতি, যাক আপনার বিশ্বাসের জোরে হতেও পারি কোনো একদিন, যদি বেঁচে থাকি! প্রিয়জন বলে কথা! আপনাদের বিশ্বাসেই আমার বিশ্বাস। আজ নয়তো কাল। যদি না হতে পারি, তাহলে আপনাদের ধারণা আর বিশ্বাস দুটিতেই ভুল ছিল। আমিতো বলিনি, বলেছেন আপনারাই! সারা মাস, বছরজুড়ে কাজ করি, মাস শেষে যা পাই, তা ভাগ করে খাই, প্রয়োজনে খরচ করি। আমার স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে আপনাদের স্বপ্নের যোগান দিই। কী ভাবছেন? আপনাদের ভালোবাসা চোখে পড়ে না! আচ্ছা ভালোবাসা কি দেখা যায়? আর আপনাদের স্বার্থপর আচরণে বুঝব, আপনারা আমাকে ভালোবাসেন! তা কী করে হয়? আপনাদের চাওয়া পাওয়ার হিসাব নিকাশেই তো ভালোবাসার পরিচয়! আমি, আমরা প্রবাসী! প্রতিটি টাকা খরচ করার আগে ভেসে উঠে আপনাদের খরচের, আপনাদের চাহিদার দরজা জানালাগুলি কী করে দোল খায়? রেস্টুরেন্টের দোকানি প্রবাসীকে দেখলেই হাসে, প্রতিদিন জিজ্ঞেস করি, ভাই এটা কতো? ওটা কতো, শেষে বলি ভাই, একটা রুটি দেন, একটু ঝোল দেন! নয়তো ক্যাটারিং সস্তা খাবার বুকিং দিই। দোকানি আবারো হাসে, মাঝে মাঝে বলেই ফেলে, আর কতো কামাই করবেন। নিজেরেও কিছু দেন? ঠোঁটের কোনে মোলায়েম হাসি টেনে ফিরে আসি রাস্তায়। এ দিকে তাকাই। ও দিকে তাকাই, তাকাই আকাশের দিকে। চলে যাই কাজে। সার দিন, সারা রাত মালিক আর সহকর্মীদের সাথে গোল্লাছুট চলে। কখনো চলে পাশা খেলা! রাতে ফিরি, বন্ধুরা ডাকে কেউ, কি রে খাবি না, উত্তরে বলি, না ক্ষিদে নেই। সিঁড়ির রেলিং ধরি, এক পা, দু পা করি উপরে উঠি, ল্যান্ডিং এ বসে পড়ি। ভাবতে থাকি কিস্তির টাকা দেয়া হয়নি। বাচ্চাদের স্কুলের খরচ, বাবা মায়ের ওষুধপত্তর, ঘর ভাড়া, আরও কত কী!
বিছানায় শুয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকি, একটা খবর নেব, না থাক! রিং বাজলেই বুকের মাঝে মোচড় দেয়, নম্বর দেখি, ভয়ে ধরি না, এই বুঝি এলো নতুন কোনো খরচের ফর্দ। বুকের মাঝে জ্বালা পোড়া বাড়ে। খাটের পাশে রাখা ঝুড়ি হাতড়িয়ে একটি ক্যাপসুল চালান করি। বন্ধ করি মোবাইলটা। যদি বেজে উঠে, আবার যদি কোনো খরচের সংবাদ আসে? বন্ধুরা মস্কারি করে, অনেক দিন হলো, কি ঠাণ্ডা হয়ে গেলি নাকি, বাড়ি যাবি না? উত্তর দিই না, মুচকি হাসি। আসলে বাড়ি যাবো টিকিটের টাকা কই? যে কয় মাস দেশে থাকবো খরচ পাবো কই? ছুটিতে গেলে আজকাল চাকরিটাই চলে যায়! জুৎসই কর্মস্থল ঠিক থাকে না?
মাঝে মাঝে বাবা বলেন? আমার স্বপ্ন পূরণ করলে না? চুপ থাকি, মাঝে মাঝে যে বন্ধুরা একটু ভালো আছে, তারা জিজ্ঞস করে, তোর ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? হাসি, মৃদু হাসি, মনে মনে বলি, এ মাসের বেতন পেলে, ওকে এতো দিতে হবে, তাকে এতো দিতে হবে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করব কখন? মাঝে মাঝে বউ বলে, আমি কি বেহুদা খরচ করি নাকি? না, সোনা দানা দিয়া মোড়াইয়া রাখছ, তোমার বাড়িতে দাসী-বান্দীর মতো কামলা দিই, না ঘর, না বাড়ি, কী আমার সন্তানের ভবিষ্যত? মাঝে মাঝে আবার মুড ঠিক থাকলে বলে, বাড়ি আসবা কবে, কিচ্ছু ভালো লাগে না, আইচ্ছা ভালো লাগা আর অর্থ, প্রয়োজন কেমন সাংঘর্ষিক তাই না?
মুরগির জন্য মায়া হয়, আবার মেহমানের জন আফসোস হয়! হয় মুরগি না হয় মেহমান একটা তো বেছে নিতে হবে, তাই না! প্রবাস, এক বন্ধু নাম দিছে প্র-বাঁশ! দেহের ইঞ্জিন যেভাবে ডিস্টার্ব দিচ্ছে, বহুত জলদি কিছু একটা হইবার পারে! কিন্তু এখনো যে অনেক কাজ বাকি। মাঝে মধ্যে এইডাও মনের মধ্যে আসে, আমি না থাকলে ওদের জীবন কি থেমে যাবে? কখনোই না, আছি তাই আমার উপর ঝামেলা আসে, আমি নাই, ঝামেলাও নাই। কাজের যা অবস্থা তাতে এই শরীর আর শরীর থাকার কথা না,বছর শেষ হইলে পারমিট হইতে পারে, নাও হইতে পারে। এই কথা কইলে দেশে আবার দুশ্চিন্তা করব। থাক, এই চিন্তাটাও আমারি থাক।
বাবা বললেন, আমার স্বপ্ন পূরণ করলা না, বউ কইলো সুখ দিলা না, কি ছাতার বিদেশ করো? আসলেই তো প্র-বাঁশে, কি ছাতার বিদেশ করি, সবাই অসুখী। পাঠকই বলেন, প্রবাস না প্র-বাঁশে আছি!
লেখক : সিঙ্গাপুর প্রবাসী