নয়া আলো ডেস্কঃ- বিএনপির বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন সম্প্রতি তার ফেইসবুকে একটি হৃদয়স্পর্শী স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন আমার টাকা নেই তাই আলালের ঘরে দুলালরা মনোনয়ন পায়। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে পথহাটা বিএনপির একজন নিবেদিতপ্রাণ, নেতা ও কর্মী আসাদুজ্জামান রিপনের এই আকুতি শুধু তার একার নয়। এই আকুতি আজকের বাংলাদেশের সকল আর্দশিক নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতাকর্মীর। হৃদয় নিস্তৃত আকুতি।
ছাত্রদলের সাবেকই নয় মহাদুর্দিনের সাধারণ সম্পাদক রিপন ঢাকসুতে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলেন সেই দুদু-রিপন পরিষদ বিপুল ভোট পেয়েও পরাজিত হয়েছিল। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ মনোনীত সুলতান-মোস্তাক পরিষদের কাছে। নব্বইত্তর গণতন্ত্রের জামানায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দুই দুইবার ক্ষমতায় এসেছে। দলের অনেক নেতাকর্মী মনোনয়ন নিয়ে এমপি. মন্ত্রী হয়েছেন।কিন্তু রিপনের ভাগ্যে না জুটেছে এমপি, মন্ত্রী না জুটেছে দলীয় পদবী। নিজের যোগ্য অনুযায়ী দলের কাছে কখনও সমাদর পাননি।
আসাদুজ্জামান রিপন ও তার সময়কার ছাত্রদলের সভাপতি শামছুজ্জামান দুদু দুইজনই চীনাপন্থী বাম ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসে ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। দুইজনেরই ব্যাপক পড়াশুনা রয়েছে। রয়েছে একটি স্বচ্ছ ইমেজ। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দুদু বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হলেও রিপন বিশেষ সম্পাদক হয়েছেন মাত্র।
বিএনপির রাজনীতিতে নেমে আসা এই মহা দুসময়ে তারা কঠিন পরিস্থিতি বা প্রতিকূল পরিবেশে দলের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করছেন। তাদের কর্মীরা অনেকেই এমপি মন্ত্রী হয়েছেন, দলের দায়িত্বশীল পদপদবী পেয়েছেন। কিন্তু প্রাপ্য মর্যাদা তাদের ভাগ্য সুসময়েও জুটেনি, দুঃসময়েও না। আসাদুজ্জামান রিপন যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন সেখানে আরো অনেক কথা লিখেছেন।
পাঠকদের জন্য তার পুরো স্ট্যাটাস তুলে দিলাম:
আমি ড. আসাদুজ্জামান রিপন ! আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। সমাজ পরিবর্তনের সোনালী নেশায় কৈশোরেই প্রেমে পড়ে যাই “রাজনীতির”। হারাতে হয়েছে জীবনে অনেক স্বর্নালী সময়। চুরি হয়ে গেছে অবেলায় অনেক স্বপ্ন। বন্ধুরা যখন প্রেমিকার হাত ধরে গাছের নিচে প্রেমের জাল বুনছে, আমি তখন উদ্ধত হাতে পিচঢালা রাজপথে গগন বিধারি চিৎকারে আকাশ বাতাশ কম্পিত করে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।বন্ধুরা যখন পড়া লিখার ইতি টেনে নিজেকে সেট করার জন্য এই অফিস ঐ অফিস ছুটছে, আমিও তখন তীব্র বেগে ছুটে চলছি, এই ডেরায়, ঐ ডেরায় পুলিশের সাথে ইঁদুর বিড়াল খেলে।
নিজেকে সেট করে প্রেমিকার মেহেদী রাংগা চুড়ি পরা হাত ধরে বিয়ের আসরের দিকে এগিয়ে যায় আমার হাতেও তখন লোহার চুড়ি পড়ে অন্ধকার কারাগারে এগিয়ে যাই।লাল নীল আলোক সজ্জায় রঞ্জিত বাড়ি থেকে ফুলেলা গাড়িতে যখন নতুন ঠিকানায় রওনা দেয় বন্ধুরা আমিও তখন সারেন বাজিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাই। আমার গাড়িতে থাকে ফুলের পরিবর্তে নিশ্বাস নেওয়ার ছোট ছোট কিছু ফুটা। আমি অন্ধকার সেই লোহার গাড়ির ভিতর ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে বন্ধুর নতুন ঠিকায় যাওয়া দেখি। আমিও যাচ্ছি পৃথিবীর মাঝে চার দেওয়ালের আরেক পৃথিবীতে।বন্ধু যখন প্রিয়াকে নিয়ে ফুলশয্যায় আমি তখন আমদানি হয়ে ইলিশ ফাইলে…..মেঘে মেঘে অনেক বেলা চলে যায়।
বন্ধু তার টাকায় বাবাকে হজ্বে পাঠায় আর আমার বাবা থানা -পুলিশ, কোর্ট কাচারি ঘুরে বৃদ্ধ বাবা ক্লান্ত হয়ে রণে ক্ষান্ত দিয়ে অন্য ভুবনে চলে যায় আমার আর্ত চিৎকার চার দেওয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনি হয়ে নিজের কানেই ফিরে আসে। একদিন মা হারিয়ে যায় আকাশের তারা হয়ে, আমি তখন দূরে বহু দূরে অন্ধকার কারা প্রকোষ্টে । এইভাবে পড়ন্ত বেলায় আমি দাঁড়িয়ে একা বড় একা। একটু তৃপ্তি নিজের প্রাণ প্রিয় সংগঠনের স্বীকৃতি, কিছু ভাই অভিভাবক, অনুজের ভালবাসা, হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা…. বয়স তখন মধ্য গগণ পার হয়ে পড়ন্ত বেলায় হেলে পড়ে……এই জীবন কাহিনী শুধু আমার নয় রাজনীতির মায়াজালে বন্ধু সকলের। কালের সাক্ষী, কালের ইতিহাস হয়ে বয়ে বেড়াতে হয় আমাদের।
কিন্তু যখন কোন জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ আসে, নিজের এত দিনের কষ্টের, শ্রম ঘামের মূল্যায়নের সুযোগ আসে তখন পাহাড় সমান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমার অর্থনৈতিক মানদণ্ড। কিছু অর্বাচীন এগিয়ে আসে, বলে নির্বাচন করতে অর্থ লাগে, তার অর্থ নেই তাই তাকে নয় আলালের ঘরের সর্ব সুখ ভোগী আমার সেই বন্ধুকে মনোনয়নের জন্য এগিয়ে আনা হয়।আমার অনেক কষ্টের, শ্রমে পাথুরে জমিন যখন ফসলে ভরপুর তখন বর্গী এসে তা ভক্ষণ করে। তখন আমার বুকের আর্তনাদ অট্টহাসি দিয়ে আমায় উপহাস করে।
কেউ কি ফিরিয়ে দিতে পারবে আমার সেই বর্নীল সময়?? প্রেমিকার কোলে শুয়ে মাথায় বিলি করে দেওয়া স্বপ্নিল সময়? আলোকিত আতসবাজির মাঝে নতুন জীবনের হাতছানি?? ফুলসয্যার রাত, প্রিয়ার লাজুক হাসি! বাবার হাসিমাখা মুখ?? মায়ের মায়াবী মুখ না কিছুই আমি পাবোনা।তবে কেন আমায় বঞ্চিত করা হবে আমার প্রাপ্যতা থেকে?? বন্ধুরা আসুন এগিয়ে বন্ধ হোক এই তামাশা।
রিপন চেয়েছিলেন ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন। অবিভক্ত ঢাকার মেয়র হবার আগ্রহ তিনি তার দলীয় নেত্রীর কাছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এবার উত্তরে নির্বাচন হোক বা না হোক মনোনয়ন তিনি পাননি। পেয়েছেন দলের শিল্পপতি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর পুত্র তরুণ শিল্পপতি তাবিথ আউয়াল।
তাবিথ আউয়াল আগের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। অকাল প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে বৈরি পরিস্থিতিতে ভোটযুদ্ধ করে দলের সিদ্ধান্তে মধ্য দুপুরে ভোট বর্জন করেও তিনলাখ ১৫ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। তাবিথের যোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা নিয়ে কিংবা তার মনোনয়ন পাওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। প্রশ্ন তুলছি আসাদুজ্জামান রিপনদের মতো দলের আর্দশিক নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ যাদের অর্থবিত্ত পেশি শক্তি নেই তারা কেন মনোনয়ন পাবেন না।
রাজনীতিতে কেবল বিত্তশালী বা পেশিশক্তির অধিকারীরাই মনোনয়ন পাবেন। এই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকেও দলের নিবেদিত প্রাণ রাজনীতির পথহাঁটা গণমুখী কোন প্রার্থীর নাম আসেনি। নাম এসেছে বিজিএমইএয়ের সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলামের। আতিক একজন ভদ্র, সৎ কর্ম উদ্যোগী নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ হলেও রাজনীতিতে তার কখনও পায়চারি ছিল না। দেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকেই সিজনাল পলিটিশিয়ানের অভাবে ব্যবসায়ী পাত্র খোঁজার মতো প্রার্থী খুঁজতে হয়েছে।
দিনে দিনে আমাদের রাজনীতি বলা হয় ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে। বলা হয় সারাজীবন দাপট ও সুখের জীবন কাটানো অবসর প্রাপ্ত সামরিক বেসামরিক আমলাদের হাতে চলে যাচ্ছে। তাদের যোগ্যতা ও রাজনীতি করার এমনকি দলীয় মনোনয়ন লাভের অধিকার নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি না। প্রশ্ন তুলছি বড় দুই দলেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেউলিয়াত্ব এতটাই তীব্র হয়েছে যে মেয়র নির্বাচনে হায়ার করতে হয় তাই নয় সংসদ নির্বাচনেও ব্যবসায়ী অবসর প্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ডেকে এনে দলীয় মনোনয়ন তুলে দেয়া হচ্ছে। সারাজীবন দলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন।
গোটা রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে এক অস্থির অশান্ত সময় দেখা দিয়েছে। যেখানে দলগুলোতে কি আওয়ামী লীগ কি বিএনপি যেখানেই নির্বাচন সেখানেই দলের আর্দশিক গরীব সৎ নেতাকর্মীরা অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন। কেবল বড় বড় শিল্পপতি ও মেধাবি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বেসামরিক আমলাদের সুযোগ দিলেও সীমারেখা সেখানেই থামছে না। বছরের পর বছর যুগের পর যুগ দিনে দিনে শাসক দলের ছায়ায় আশ্রয় নেয়া একদল উঠতি ঠিকাদার বা অর্থবিত্তের মালিক হওয়া মেধাহীন লোকজন দলীয় মনোনয়ন নিচ্ছে।
এতে করে সংসদ সংসদীয় রাজনীতির জৌলুস ও উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলছে। অর্থ শক্তি পেশি শক্তির কাছে দিনে দিনে রাজনৈতিক শক্তি পরাস্ত হচ্ছে। কি নারী কি পুরুষ সবখানেই দলের প্রতি অনুগত নিবেদিতপ্রাণ গণমুখী পরিচ্ছন্ন ক্লিন ইমেজের নেতাকর্মীরা অর্থবিত্ত না থাকার কারণে মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন না রাজনীতিতেও কর্তৃত্ব হারাচ্ছেন, প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়ছেন। রিপনের আকুতি কেবল একজন আসাদুজ্জামানের আকুতি নয় কেবল একজন বিএনপি কর্মীর অন্তহীন হাহাকার ও দহনের বা না পাওয়ার বেদনা মিশ্রিত ক্রন্দনই নয় সকল রাজনৈতিক দলের আর্দশিক নেতাকর্মীদের আহাজারি মাত্র।
রাজনীতি যদি হয় সততার স্বচ্ছতার জবাবদিহিতার এবং গণমুখী, কর্মীবান্দব চরিত্র নিয়ে মানবকল্যাণের তাহলে বড় দুই দলকেই আর্দশিক নেতাকর্মীদের জন্য রাজনীতির দুয়ার খুলে দিতে হবে। রাজনীতির প্রতি , রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের আস্থা, ভালবাসা, সম্মান ফিরিয়ে এনে হতাশা দূরীভূত করতে হলে রাজনীতির দুয়ার রাজনীতিবিদদের জন্য খুলে দিতে হবে।
সকল দলের নেতৃত্বের কাছে আবেদন গণমানুষের কল্যাণের রাজনীতির জন্য দলে দলে আর্দশিক মেধাবী কর্মীদের জন্য রাজনীতির দুয়ার খুলে দিন। অর্থ ও পেশিশক্তির কাছে আর্দশিক নেতাকর্মীর পরাজয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই পরাজয়।