সৈয়দ মুন্তাছির রিমন :
‘‘মোদের গৌরব মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা’’
অতুল প্রসাদ সেনের উক্তির যথেষ্ট স্বার্থকতা রয়েছে। কেননা বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যার রয়েছে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা অধিকার আদায়ের জন্য বুকের তাজা রক্ত দেয়ার গৌরবময় ইতিহাস। শহীদ শফিক, রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকই মাতৃ ভাষা রক্ষার আন্দোলনে রাজপথে নেমে আসে। সর্ব প্রথম এই আহবানে এদেশের মানুষের নিদ্রা যেমন ভেঙ্গেছে, তেমনি ৬দফা আর ১১ দফা দাবির শপথে ও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে বায়ান্নর পথ বেয়ে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধের পথ উন্মোচিত হয়। আমাদের জীবনে নিঃসন্দেহে এসব শ্রেষ্ট ঘটনা। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ এই ১৯০ বছর দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে এদেশকে শাসন-শোষণ করেছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। ইংরেজরা ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারত বর্ষকে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান বানিয়ে ধর্মভিত্তিক দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে যায়। ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েই সেদিন অভ্যূদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের। এ নতুন রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ হলো পশ্চিম “পাকিস্তান এবং অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান। তৎকালীন সরকার ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। আর তখনই শুরু হয় সংগ্রাম ও আন্দোলন। এ আন্দোলনে নিহতের স্মরণে মাহবুব উল আলম চৌধুরী “কাঁদতে আসিনি ফাঁসি দাবি নিয়ে এসেছি” কবিতায় লিখেছেন-
“আজ আমি শোকে বিহবল নই
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল।
আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে
নির্বিচারে হত্যা করেছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্ররা হাতের মুঠোয় মৃত্যু নিয়ে স্বপ্নের পথে পা বাড়িয়ে ছিল আর তাদের পদচিহ্নে প্রতিনিয়ত জন্ম হয়েছে নতুন ভোর। যে ভোরের সূর্যোদয়ে বিলীন হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃশাসন। তৎকালিন সময় বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে উত্তাল ছিল বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এমনকি সারাদেশের ভাষাপ্রেমী জনতা। ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার এ সংগ্রামী ইতিহাস সারাবিশ্বের মানুষ জানে। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মহান মাতৃভাষা একুশে দিবস। এই দিন শক্তি করে প্রতিটি বাঙালি স্বশ্রদ্ধচিত্রে স্মরণ করে সূর্য সৈনিকদের। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতিটি বাংলাদেশি নাগরিকের মতোই আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষও গভীর ভাবে স্মরণ করছে অমর শহীদদের কথা।
একুশে ফেব্রুয়ারি আর একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা। প্রথমটি সৃষ্টি, গৌরব ও মর্যাদার কথা বলে এবং দ্বিতীয়টি ভবিষ্যত রচনা কথা বলে। ১৯৫২ আর ২০১৮ এক সূত্রে মেলালে চলবে না। ইন্টারনেট, অবাধ তথ্য সরবরাহের প্রবাহের যুগে গোটা বিশ্ব এখন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। যা অনেক ব্যক্তি তথা দেশ গোটা বিশ্বকে “গ্লে¬াবাল বিলেজ” হিসেবে মনে করে। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী” এ গান গেয়ে একুশের চেতনা ও তাৎপর্য তুলে ধরার গতানুগতিক থেকে বের হয়ে নতুন চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর প্রায় ২৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হলেও একমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা। বাংলা ভাষায় রয়েছে অফুরন্ত শক্তি, প্রাণের স্পন্দন ও সম্ভাবনা। তাই কেবল আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির মধ্যে ভাষাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, মাতৃভাষা ও সাহিত্যের আরো শ্রীবৃদ্ধির জন্য বিদেশী সাহিত্যের গ্রন্থাদি অনুদিক আধুনিক ইন্সটিটিউট এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মাতৃভাষা কেবল শিক্ষার মাধ্যম এবং অফিস আদালতের ভাষা হিসাবে নয়, আমাদের সৃজনশীল চেতনার মধ্যে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও শক্তিকে স্বার্থকভাবে ব্যবহার করতে হলে বাংলা ভাষা চর্চার ব্যাপক আকার সৃষ্টি করতে হবে। দেশের গ্রামে গঞ্জে রয়েছে এক বিশাল ছাত্র সমাজ । যেখানে ভাল শিক্ষক নেই ও লাইব্রেরী নেই। ফলে তারা বাংলাতেই শিক্ষা গ্রহণ করছে। তাই একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এসব বঞ্চিত শিক্ষার্তীদের বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালবাসি” গানকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা এবং অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা থেকে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে ঠিকই। তবেই সর্বস্তরের বাংলার প্রচলন এখনো সম্ভব হয়নি। এদেশের অনেকেই বাংলাকে ভালবাসি লিখতে-পড়তে পারে না। তাই তাদেরকে বাংলায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা দরকার। কথায় আছে কষ্টের ধন, থাকে চিরকাল। সত্যিই এ ভাষা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। কিন্তু আজও তার প্রকৃত স্বাদ ভোগ করতে পারিনি। আজও বাংলা ভাষায় লিখতে গিয়ে লেখক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক নির্যাতন এবং হত্যা বা নিহত হয়েছেন। আমাদের জাগ্রত চেতনার মতোই যা অম্লান সেই মাতৃভাষার বিকাশে আরো কিছু করার আছে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হল দেশে আর লোকজ বাঙ্গালি সংস্কৃতি বিকাশে সরকারি ও