নয়া আলো- বছর ঘুরে রমজান এলেই বাড়ে ইফতারি পণ্যের দাম। রমজান শুরুর আগে থেকেই অনেক নিত্যপণ্যের দাম বাড়া শুরু হয়। বাজারে ছোলা, চিনি, ডাল, খেজুর, মাছ, মাংসসহ সবকিছুরই দাম বেড়েছে গত কয়েক দিনে। আর নতুন করে যোগ হয়েছে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচসহ সব ধরনের সবজির বাড়তি দাম। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরবরাহ ভালো এরপরও এসব পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, রমজানের আগের দিন হওয়ায় গতকাল অনেকেই ১৫ দিনের কেউবা পুরো মাসের কেনা-কাটা করেছেন। ক্রেতার চাপ বাড়ায় অরেক দফা বেড়েছে কিছু পণ্যের দাম। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যান ও রাজধানীর বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব পণ্যভেদে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৫ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা পর্যন্ত।
এদিকে গত ১৭ই মে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, চাহিদার তুলনায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের অতিরিক্ত মজুদ থাকায় দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী বিপুল পরিমাণ মজুদ থাকার যুক্তি দেখিয়ে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলেও দেশবাসীকে আশ্বাস দেন। কিন্তু সেই আশ্বাস আমলে আসেনি। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একশ্রেণীর অতি মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ী জোটবদ্ধ হয়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে কারসাজি করছে।
রাজধানীর কাওরান বাজারের মা জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিনে রমজান উপলক্ষে তেমন একটা বেচাবিক্রি হয়নি। স্বাভাবিক ছিল।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ টাকা। তিন দিন আগেও প্রতি কেজি ৬২ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে চিনির দাম ৬৫ টাকা। গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৫৫ টাকা থেকে ৫৮ টাকা। এক মাস আগেও চিনি বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। একই সঙ্গে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। বাজারে দেশি পেঁয়াজ ৪৫-৫০ ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। টিসিবি’র হিসাবে, বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। গত মাসে আমদানি করা পেঁয়াজে কেজিতে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে অস্ট্রেলিয়ান ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫, বার্মিজ ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১০০ এবং দেশি ছোলা ৯০-১১০ টাকা। সূত্র জানায়, প্রতিমাসে দেশে ছোলার চাহিদা প্রায় ১২ হাজার টন। রমজান মাসে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টনে।
এ ছাড়া বাজারে প্রতিকেজি মসুর ডাল (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা, নেপালি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকা থেকে ১৫০ টাকায়। কানাডার বড় দানার মসুর বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। অস্ট্রেলিয়ান ছোট দানার মসুর বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। মটর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে আমদানি করা রসুনের দাম। বাজারে বর্তমানে দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। গত মাসে এটি বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে। টিসিবি’র হিসাবে, এক মাসে পণ্যটির কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আর আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে। এটিও গত মাসে কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৭০ থেকে ১৯০ টাকায়।
ভোজ্য তেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৯০, সুপার ৭৫, বোতলজাত সয়াবিন তেলের মধ্যে প্রতি ৫ লিটারের বোতল পাওয়া যাচ্ছে ৪৪৫ থেকে ৪৫৫ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া মানভেদে প্রতি কেজি খোলা সরিষার তেল ১২০-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খেজুরের দামে একটু স্থিতিশীল দেখা গেছে। পণ্যেটির দাম তেমন বাড়েনি। টিসিবি‘র তথ্য মতে, বর্তামানে প্রতিকেজি খেজুর (সাধারণ মানের) ৮০ থেকে ২২০ টাকা। অর্থাৎ গত বছর রমজানের আগে এই দামেই বিক্রি হয়েছে পণ্যটি।
সবজির বাজার ঘুরে দেখা যায়, সবজির দাম এত দিন ক্রেতার নাগালে থাকলেও এখন বাড়তে শুরু করেছে। ইফতারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বেগুন। বাজারে দেখা গেছে, বেগুনের দাম বাড়ছে। অন্য সবজিও ৪০ থেকে ৬০ টাকার নিচে মিলছে না। এ ছাড়া খয়েরি ও সবুজ রঙের গোল বেগুন বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৭০ ও ৬০ টাকা করে। টমেটো কেজি ৪০-৪৫, কাঁচামরিচ ৬০-৮০, ধনেপাতা ৮০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া গাজর ২৫, বরবটি, পটোল ও ঢেঁড়স বিক্রি হচ্ছে ৩০, করলা ৪০, পেঁপে ২৫-৩০, শসা ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৮-২০ টাকায়।
বাজারে ব্রয়লার প্রতি কেজি ১৬০-১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আকার ভেদে দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৯০-৩১০ টাকা কেজিতে। পাকিস্তানি মুরগি পিস ২০০ টাকা এবং কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা দরে। এ সপ্তাহে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৪২০-৪৫০ টাকা কেজি। তবে খাসির মাংস আগের দামে ৫৬০-৫৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চলতি সপ্তাহে রুই, কাতলা, শিং, তেলাপিয়াসহ বেশ কিছু মাছ কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ৩৫০-৫৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৮০-৭০০ টাকায়। তবে ছোট আকারের রুই পাওয়া যাচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকার মধ্যে।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, রমজান সামনে রেখে অতিরিক্ত মুনাফা করার আশায় ‘ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট’ কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে বাজার চড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। যৌক্তিক কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে ডাল, লবণ, পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে চিনির চাহিদা রয়েছে ১৪-১৫ লাখ টন। এর মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১৮ লাখ ২৫ হাজার টন চিনি প্রবেশ করেছে। গত বছরের রয়ে যাওয়া মিলিয়ে এখন ২২ লাখ টনের মতো চিনি রয়েছে। গত বছর ১৭ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে। সেখান থেকে ২ লাখ টন রয়ে গেছে। এর সঙ্গে আরো ১৪ লাখ টনের মতো যোগ হয়েছে। এখন দেশে ১৬-১৭ লাখ টন আছে। আরো কয়েক লাখ টন পাইপ লাইনে রয়েছে।
মসুর ডালের চাহিদা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন। দেশে উৎপাদিত হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার টন। ইতিমধ্যে ২ লাখ টন আমদানি করা হয়েছে।
ছোলার চাহিদা ৬০ হাজার টন, দেশে উৎপাদিত হয় ৭ হাজার টনের মতো। গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৫৫ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে। এ বছর ২ লাখ ৬৫ হাজার টন প্রবেশ করেছে।
বর্তমানে ১৩ হাজার টন খেঁজুরের চাহিদা আছে। এরই মধ্যে ২৭ হাজার টন দেশে প্রবেশ করেছে। খেজুরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ২২ লাখ টনের চাহিদার বিপরীতে দেশে ১৭ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে। ৬ লাখ টন দেশে প্রবেশ করেছে।
রসুনের ক্ষেত্রে ৫ লাখ টনের চাহিদা। দেশে ৪ লাখ ৬৫ হাজার টন উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ হাজার টন আমদানি হয়েছে, আরও এলসি খোলা হয়েছে। সেগুলো হলে রসুনের কোনো ঘাটতি থাকবে না। আদার ক্ষেত্রেও তাই, হলুদের ক্ষেত্রেও তাই।
বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত মজুদ আছে। অস্বাভাবিক মূল্য ?বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই।