১২ বছর পর শুভনিল তার মেয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে সিরাজগঞ্জ শহরে বেড়াতে এলো । সেই চেনা শহরটা আজ বরই অচেনা লাগছে তার কাছে।মেয়েকে এই শহরের কথা
অনেকবার বলেছে ।মেয়ে বৃষ্টিরও এই শহরটা দেখার আগ্রহের কমতি ছিল না । আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী তার জন্য একটি বিশেষ দিন আর এই দিনটাকেই সে মেয়েকে নিয়ে
এই শহরে আসার জন্য ভেবে রেখেছিল। কিছু পরিচিত ব্যক্তি ছাড়া তার কোন আত্নীয় স্বজন এই শহরে নেই।আজ ভোরে রওনা হয়েছিল তার নিজ শহর চুয়াডাঙ্গা হতে
আবার আজকে রাতের ট্রেনেই ফিরতে হবে।
এই শহরটা আজ খুবই অপরিচিত লাগছে ,কেন জানি তার মনে হচ্ছে এটা অচেনা কোন শহর । শহরের মধ্য দিয়ে রিক্সায় চরে মেয়েকে নিয়ে ঘুরছে,মেয়েকে শহরটা
চেনাতে চাচ্ছে ,কিন্তু সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না ১২ বছর আগের সেই চেনা স্থাপনাগুলো ঠিক আগের মত আছে কিনা।
রিক্সা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তার চোখে পড়লো সেই ক্লিনিক যেখানে তার মেয়ে বৃষ্টির জন্ম ।তখন ক্লিনিকটা অনেক পুরাতন ছিল, কিন্তু এখন অনেক পরিবর্তন
হয়েছে।তারপরও তার চিনতে অসুবিধা হয়নি।
শুভনিল রিক্সা ওয়ালাকে ক্লিনিকের সামনে রিক্সা থামাতে বলল এবং রিক্সা থামাতেই সে ক্লিনিকের দিকে ডান হাত উচু করে বৃষ্টিকে বলল “ মামনি এই ক্লিনিকেই তোমার
জন্ম হয়েছে ।”মেয়েকে কথাটি বলতেই তার চোখ দুটো জলে ছলছল করতে লাগলো। কিন্তু বৃষ্টি দেখে ফেলার আগেই তার কান্নামাখা মুখটি অন্য পাশে ঘুরিয়ে
রিক্সাওয়ালাকে বলল,“ ভাই আপনি রিক্সা চালান।”
রিক্সাওয়ালা রিক্সা চালাতে চালাতে একটু হেসে বলল,“ ভাই আপনারা তো অনেক্ষন হল আমার রিক্সায় উঠেছেন কিন্তু এখনও বলেন নাই আপনারা যাবেন কোথায়?”
শুভনিল রিক্সাওয়ালার কথার উত্তরে বলল, “আমাদেরকে বড়পুল হয়ে যমুনা নদীর পারে নিয়ে যান।” কিছুক্ষন পরে একটু ভেবে সে আবার বলল, “ভাই নদীর পারে একটু
পরে যাব আপনি আমাদের একটা ভাল রেস্তোঁরায় নিয়ে যান।”
রিক্সাওয়ালা একটু আশ্চর্য্য ভঙ্গিতে বলল, “ভাই রেস্তোঁরা তো আমি চিনিনা সেটা আবার কোথায় ?”
শুভনিল বুঝল তার কথা সে বুঝতে পারে নাই তাই সে আবার বলল ,“ভাই আপনি আমাদের একটা ভাল খাবার হোটেলে নিয়ে যান।দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের কিছু
খেয়ে নিতে হবে,পরে আর সময় পাব না।”
শুভনিলের কথা শুনে রিক্সাওয়ালা আবার একটু হেসে বলল,“ ভাইজান আমি লেখাপড়া জানি না ,তাই আপনার কথা বুঝতে পারি নাই কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি।চলেন
আপনাদের একটা ভাল খাওয়ার হোটেলে নিয়ে যাই।” এই বলে রিক্সা চালাতে শুরু করল।
প্রায় ঘন্টা খানেক পরে খাবার হোটেল থেকে বেরিয়ে শুভনিল রিক্সার খোজ করতেই সেই রিক্সাওয়ালা এসে বলল,“ ভাই ওঠেন।”
শুভনিল অবাক হয়ে বলল ,“ভাই আপনি আমাদের জন্য এত সময় হলো এখানেই বসে ছিলেন?”
রিক্সাওয়ালা বলল, “ জ্বী ভাইজান ভাড়া পাই নাই।এখন বলেন কোথায় যাবেন ? ”
শুভনিল বলল,“ঐ যে তখন বললাম বড়পুল হয়ে যমুনা নদীর পারে। ভাড়া কত লাগবে ।”
রিক্সাওয়ালা বলল, “মিটান লাগবে না ভাই, চলেন নামিয়ে দিয়ে আসি, কিছুক্ষন পরে আর রিক্সা পাবেন না । আজকে নাকি ভালোবাসা দিবস, পেটে ভাত না থাকলে
আবার ভালোবসা দিবস!” রিক্সাওয়ালা হাসতে থাকে আর বলে আপনাদের তারাতারি নামিয়ে দিয়ে আবার আসবো,আরো ভাড়া মারতে হবে। বউকে নিয়ে বেরাতে যেতে
পারব না হাতে টাকা নাই ।আজকে যা কামাই করবো তাই দিয়ে একটা মুরগী আর গোলাপ ফুল নিয়ে বাড়িতে যাবো। ঘরের ভিতরেই ভালোবাসা দিবস পালন
করবো,মনে ভালোবাসা থাকলে ঘরেও যেমন বাইরেও তেমন।কি বলেন ভাইজান ঠিক বলেছি না?
শুভনিল দেখলো রিক্সাওয়ালা তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে হাসি মুখ করে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে,তাই সেও একটু শব্দ করে হেসে বলল,“হ্যা ভাই ঠিকই বলেছেন।
চলুন এখন যাওয়া যাক।”
রিক্সা চলছে বৃষ্টি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছে বাবার মুখে শোনা এই শহরের দৃশ্যগুলো মিলছে কিনা ।শহরটা দেখতে দেখতে বৃষ্টি তার মায়ের কথা
ভাবছে।এই শহরেই তার মায়ের স্মৃতি জরিয়ে আছে। কিন্তু সেই স্মৃতির মাঝে সে কতটুকু সময় দখল করেছিল সেটা তার জানা নেই।এমন কি তার মা দেখতে কেমন ছিল
সেটাও সে জানে না।তার বাবা শুধু তাকে বলেছে, তোমার মা মারা যাওয়ার পর আমি তার উপর অভিমান করে সব স্মৃতিচিনহ্ তার চিতার সাথেই পুড়িয়ে ফেলেছি, তুমি
বড় হয়ে আয়নায় নিজেকে দেখ তাহলেই তোমার মায়ের প্রতিচ্ছবি তুমি দেখতে পাবে।
মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে বৃষ্টির খুব কান্না পাচ্ছিলো।চোখ দুটো ভিজে ওঠার আগেই মাথা নিচু করে বাবাকে বলল,বাবা আমার মা কোথায় থাকতো?
শুভনিল মেয়ের প্রশ্ন শুনতে পারে নাই এমন ভাব করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল কারন মিথ্যে উত্তর এর আগেও অনেকবার দিয়েছে, কিন্তু আজ আর দিতে পারলো না ।
তবে সে আজও তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো, যে প্রশ্নের উত্তরে বৃষ্টি তার মায়ের বাড়িতে যেতে চাইবে। কিন্তু মেয়ের এই চাহিদা পূরন করা শুভনিলেন পক্ষে সম্ভব
নয়।সে জানে বৃষ্টির মা তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে । তবে স্ত্রীর বাড়ির ঠিকানা তার জানা আছে । এই শহরে নয় যমুনা নদীর চরে নাটোয়াপাড়া গ্রামে।কিন্তু
সেখানে বৃষ্টিকে নিয়ে গেলে তার স্ত্রীর ঘটনা সব প্রকাশ হয়ে যাবে।সত্যিটা জানতে পারলে তার মেয়ের জীবন খুবই কষ্ট দ্বায়ক হবে।যে কষ্ট নিয়ে সে বারোটা বছর পার
করছে সেই কষ্ট মেয়েকে দিতে চায় না।
শুভনিল মেয়ের প্রশ্নের উত্তর আরাল করে হঠাৎ আনন্দিত হওয়ার ভাব করে বাম হাত দিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ডান হাত উচু করে বৃষ্টিকে বলল, “মামনি ঐ দেখ কি সুন্দর
ব্রিজ , ঐ ব্রিজের কথাই তোমাকে বলেছিলাম।প্রায়ই আমি আর তোমার মা বিকালে এই ব্রিজের রেলিং এ বসে থাকতাম সূর্য ডোবার মুহূর্ত পর্যন্ত।কি যে অপরূপ দৃশ্য! না
দেখলে বোঝার উপায় নেই। আজকে ফেরার পথে তুমি আর আমি এখানে বসে সূর্যাস্ত দেখবো।”
এই বলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার বলে,“ ব্রিজটার নাম কি জান মামনি? ইলিয়ট ব্রিজ। স্থানিয়রা নাম দিয়েছে বড়পুল । ব্রিজটা সুন্দর না মা ?
বৃষ্টি মন খারাপ করে বলল ,“ হ্যা, এই ব্রিজটা ব্রিটিশরা তৈরি করেছে এই গল্প তুমি অনেকবার আমাকে শুনিয়েছো বাবা।”
যমুনা নদীর পারে রিক্সা থামলো।রিক্সা থেকে নেমে শুভনিল মানিবেগ থেকে একটি পাঁচশত টাকার নোট বের করে রিক্সাওয়ালাকে দিল।রিক্সাওয়ালা নোটটা হাতে নিয়ে
মন খারাপ করে বলল ,“ ভাইজান এত বড় টাকার নোট খুচরা আমার কাছে নেই,খুচরা দেন ভাইজান।”
এই বলে রিক্সাওয়ালা শুভনিলকে টাকাটা ফেরত দিতে চাইল কিন্তু সে টাকাটা ফেরত না নিয়ে বলল, “আপনাকে খুচরা দিতে হবে না, আপনি আজকে আর ভারা না মেরে
এই টাকাটা দিয়ে আপনার স্ত্রীকে বেড়াতে নিয়ে যান।”
রিক্সাওয়ালা অবাক হয়ে বলল, “আপনি তো খুব লজ্জার মধ্যে ফেলে দিলেন।” এই বলে টাকাটা আবার ফেরত দিতে চাইল ।
কিন্তু শুভনিল টাকাটা ফেরত না নিয়ে বলল,“ ভাই আপনাকে আমি টাকাটা পারিশ্রমিক হিসাবেই দিয়েছি এতে লজ্জার কিছু নেই।” এই বলে আর দেরি না করে বৃষ্টির হাত
ধরে হাটতে লাগলো ও পিছন ফিরে রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিয়ে বলল ,“ভাই ভাল থাকবেন।”
রিক্সাওয়ালা টাকা হাতে এক দৃষ্টিতে বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে লজ্জার ভঙ্গিতে হেসে বিদায় জানাল।
বেলা ৩টা বাজে । নদীর পারে লোকের সমাগম বাড়ছে শুভনিল ও বৃষ্টি নদীর পারে বসে নদীর অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করছে।নদীর জলে সূর্যের আলো পরে ঢেউ গুলো
ঝিলমিল করছে।শুভনিল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ১২ বছর আগের কথা ভাবছে। ১২ বছর আগে আজকের এই দিনে তার স্ত্রী মনিকা তাকে ছেড়ে চলে যায়।তারা
ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো।শুভনিল ও মনিকা দুজনেই সিরাজগঞ্জ মেডিকেল এ্যাসিস্টেন্ট ট্রেনিং স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল।মনিকাকে বিয়ের দুই বছরের শুরূতে বৃষ্টির জন্ম
হয়।শুভনিল তখন বেকার, মনিকা একটি বেসরকারি ক্লিনিকে জুনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত ছিল।যে ক্লিনিকে বৃষ্টির জন্ম হয়েছে। মনিকার খুব একটা আয় ছিল
না।সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো।শুভনিলের পারিবারিক অবস্থা বেশ ভালো ছিল,কিন্তু বাড়ির অমতে বিয়ে করায় তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
হয়ে যায়।তাই তার বাড়ি থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতাই পেত না।যে কারনে নিজের হাত খরচের টাকাও মনিকার কাছে চেয়ে নিতে হত। মাঝে মাঝেই মনিকা এ
জন্য তার সাথে রাগারাগি করতো। নিজেকে খুব ছোট মনে হত সে বেকার বলে ,বেশি ছোট মনে হত যখন মনিকা তার সাথে রাগারাগি করতো,তখন তার সুন্দর চোখ
দুটি জলে ছলছল করে উঠত দেখে।
মনিকা ক্লিনিকে যওয়ার পর বৃষ্টিকে শুভনিলই দেখাশোনা করত।রান্নাবারি থেকে শুরু করে সব কিছুই তাকে সামলাতে হতো।এমনকি মনিকা মাঝেমাঝেই রাত্রিতে বাড়ি
ফিরতে পারতো না, তবুও সে সবকিছু মানিয়ে নিত।শুধু কষ্ট হত মেয়েটার জন্য,মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে। মনিকাও সংসারে টাকার অভাব মেটাতে না পেরে
সব সময় রাগী মেজাজ নিয়ে থাকতো।কিন্তু কি লাভ হয়েছে তাতে, সংসার তো আর করতে পারল না।অবশ্য টাকা ধরতে পেরেছে মনিকা,যে টাকার জন্য নিজের
মেয়েকেও তুচ্ছ করেছে। যেটা মনিকাকে নিয়ে সে কখনোও ভাবেনি, সে সেটাও করেছে । ডাক্তার সিদ্দিক স্যারকে বিয়ে করেছে।তাকে মনিকা কখনো বুঝতেই দেয়নি তার
ভালোবাসার অন্তরালে এমন একটি পাপ লুকিয়ে ছিল।
১২ বছর আগে এই দিনে এই স্থানেই শুভনিল তার মেয়েকে কোলে করে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছে তার স্ত্রীর জন্য।ভালোবাসার উপহার হিসেবে তার জন্য দুটো
গোলাপ ফুলও এনেছিল সেদিন। শুভনিল তখনও বুঝতে পারেনি অনেক আগেই তাদের ভালোবাসার গাছ মরে গেছে , দিন শেষে হাতে থাকা ফুলের পাপড়ি গুলোও ঝরতে
শুরু করেছে। মেয়েকে কোলে রাখতে রাখতে তার শরীর ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল ঠিকই,তবে সে ব্যাথা মনের আঙ্গিনায় পৌঁছাতে পারেনি।তার চেয়েও বড় ব্যাথা তার চোখের
দৃষ্টি খানিকটা দুরে পরতেই অনুভব করতে পারলো।মনিকা ডাক্তার সিদ্দিক স্যারের গাড়ীর ভিতরে বসে আছে, সিদ্দিক স্যার কি যেন বলছে আর তাই শুনে মনিকা সিদ্দিক
স্যারের মাথায় আঙ্গুলের ছোঁয়া দিয়ে হেসে গলে পরছে।শুভনিল আর তাকাতে পারছিল না ,তাই একটু সময় মাথা নিঁচু করে থেকে আবার মাথা তুলতেই দেখে সিদ্দিক
স্যারের গাড়ী চলে গিয়েছে।সে তখন কি করবে ঠিক বঝতেই পারছিল না।শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করছিল তার ভালোবাসা এতটা মুল্যহীন ?
সেদিন কখন যে বেলা শেষে রাত্রি নেমে এসেছে তা বুঝতে অনেকক্ষণ সময় লাগল শুভনিলের।হঠাৎ তার মেয়ের কন্নার শব্দে বুঝতে পারে এখন যেতে হবে।শুভনিল
সেদিন রাতেই মেয়েকে নিয়ে মনিকার ক্লিনিকে যায় এবং জানতে পারে মনিকা ডাক্তার সিদ্দিক স্যারকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছে।আর এও জানতে পারে আজকে রাতেই
তারা কিছুদিনের জন্য শহর ছেড়ে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবে।কোথায় যাবে তা কেউ জানে না।মনিকার বান্ধবী কর্তব্যরত নার্সের কাছে কথাগুলো শুনতে পেরে সে
আর দাড়িয়ে থাকতে পারছিল না,আর কিছু ভাবতেও পারছিল না।সে শুধু মনিকার বান্ধবী কর্তব্যরত নার্সকে বলল , “মনিকা সকালেও তো ক্লিনিকে আসার সময়
আমাকে বলল তুমি বৃষ্টিকে নিয়ে যমুনা নদীর পারে থেকো আমি চলে আসবো।তবে কেন এমন করল মনিকা ?”
মনিকার বান্ধবী এ কথার পরে আর কোন উত্তর দেওয়ার ভাষা খুজে না পেয়ে বলল মনিকার কাছে এ রকমটা কখনো আশা করিনি।তারপর আর কিছুই বলতে পারল না
মনিকার বান্ধবী।
শুভনিল আর দেরি না করে মেয়েকে নিয়ে বাসায় রওনা হয়েছিল । যাওয়ার পথে সারাটা সময় সে ভেবেছিল বাসায় গিয়ে যদি দেখতাম তুমি ফিরে এসেছো তবে তোমার
কাছে শুধু একটা অনরোধ করব,তুমি তোমার মেয়েকে এভাবে ফেলে যেওনা।শুধু ভালোবাসা দিয়ে বৃষ্টিকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না।ওর বড় হতে টাকার প্রয়োজন
সেটা আমার নেই আজ তোমার আছে।প্লিজ মনিকা তুমি ওকে নিয়ে যাও,না হলে আমরা বাবা মেয়ে না খেতে পেরে মারা পরবো।
এই সব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সেদিন চোখের জলে গাল ভিজে গিয়েছিলো বুঝতে পারেনি।শুভনিল বুদ্ধির পরে কখনো কেঁদেছিল কিনা তার মনে পরে না ।
কিন্তু মনিকার এভাবে চলে যাওয়ায় সেদিন কেঁদেছিল , কেঁদেছিল সারাটি পথ সারাটি রাত। কখনো বসে, কখনো শুয়ে আবার কখনো বা বালিশে মাথা গুঁজে।কেউ দেখেনি
দেখেছে শুধু তার মেয়ে ,কিন্তু কিছুই বোঝেনি । বোঝেনি বাবা ও তার প্রতি মায়ের কতটা অবহেলা,কতটা অবিচার। আজও তার মেয়ে বৃষ্টি জানে তার মা বেচে নেই,
বৃষ্টির বুদ্ধির পর থেকেএমনটাই জেনে এসেছে। মেয়েকে সত্যিটা বলার ভাষা তার জানা নেই । হয়তো আর কখনো বলাও হবে না।
মনিকা সিদ্দিক স্যারের সাথে এই শহরেই নাকি থাকতো,তবে বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি।সিদ্দিক স্যার পুনরায় বিয়ে করেছে।তারপর থেকে মনিকার আর কোন খোঁজ
মেলনি।মনিকা তার বাড়িতেও নাকি আর কখনো যায়নি।হয়তো আর কখনো যাবেও না। আর যাবেই বা কি জন্য টাকাই তো তার কাছে সবকিছু। স্নেহ মমতা
ভালোবাসা সবই মূল্যহীন।
শুভনিল আজ ১২ বছর পর যমুনা নদীর পারে বসে মনে মনে বলছে,“মনিকা তুমি সুখে থেকো । সুখে থেকো কোন এক সিদ্দিক স্যারের ঘরে।”
মনে মনে বলতে বলতেই তার চোখে জল এসে গেল আর তখুনি তার মেয়ে বলে উঠলো, “বাবা তোমার চোখে জল কেন ? তুমি কাঁদছো কেন?”
শুভনিল বলল না মা কিছুনা, এই বলে চোখের জল মুছতে মুছতে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল , “অতীত খুবই খারাপ মামনি কষ্টের হলে ভোলা যায় না ,আর আনন্দের হলে
ফিরে পাওয়া যায় না ” চলো মামনি সন্ধ্যে হয়ে আসলো এখন ওঠা যাক ।
শূভনিল কথাটা বলে মেয়েকে হাত ধরে তুলে দাড়াতেই একজন মহিলা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে এই তোরা শুভকে দেখেছিস ? আমার মেয়েকে দেখেছিস ? বল না দেখেছিস
?
মহিলা বলেই বারবার বুক থাপরা থাপরি করে। সে আবার বলে, “শুভ…শুভ আমার স্বামী বলনা কোথায় ওরা ..।”
শুভনিল হতবাক হয়ে যায় এ তো মনিকা ,বৃষ্টির মা ।
বৃষ্টি মহিলার আচরনে ভয় পেয়ে শক্ত করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে ,“বাবা চলো।”
কিন্তু না শুভণিল মেয়ের কথায় কোন সাড়া দেয় না , সে শুধু এক দৃষ্টিতে মনিকাকে দেখছে আর ভাবছে, এ কি সত্যিই মনিকা নাকি অন্য কেউ ।
হ্যাঁ, এ সত্যিই মনিকা তার স্ত্রী।শুভনিল এখন কি করবে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ।
বৃষ্টি বাবাকে স্বজরে ধাক্কা দিয়ে বলে,“ বাবা আমার ভয় করছে ।”
শুভনিল তবু মেয়ের দিকে না তাকিয়েই বলে ফেলল, “মনিকা আমাকে চিনতে পারছো ? ” আমি শুভ,শুভনিল।
মনিকা শুভনিলের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে,“ তুই আমার স্বামী হা..হা..হা ।” এই বলে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে, “এই মেয়ে তুই কে ? তুই কি আমার মেয়ে ?
হা..হা..হা তোরা সব সয়তান সব। আমিও সয়তান হা..হা..হা শুধু আমার শুভ ভাল। আর কেউ ভাল না তোরা কেউ না, আমিও না ,হা..হা..হা । ”
মনিকার এই আচরনে শুভনিল আর স্থির থাকতে না পেরে মনিকার হাত ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতেই মনিকা তার হাত সজোরে ঝাঁকি দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে
বলে,“তুই সয়তান, তুই সিদ্দিক।” হা..হা..হা করে হাসতে হাসতে দৌড়ে ভিরের মাঝে হরিয়ে গেল।
শুভনিলের চোখে জল,তার জলে ভরা চোখ দুটি ঝাপসা দৃষ্টিতে মনিকাকে এদিক ওদিক খুজতে থাকে, কিন্তু না মনিকা আর ফিরে এলো না।
বৃষ্টি বাবাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষন । সব কিছু তার কাছে কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগছে। কেন এমন করলো মহিলাটি আর বাবাই বা কেন তার কথার সাথে
তাল মিলিয়ে বলছিল আমি শুভ আমি শুভনিল ?
শুভনিল বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখে বৃষ্টি কান্না করছে ও ভয়ে কাঁপছে।সে মেয়েকে আরো ভাল করে জড়িয়ে ধরে বলে, “ভয় নেই মা, চলো এবার যাওয়া যাক।এ শহরে
আর কখনো আসবো না এই শহরটা আমাদের জন্য নয় ।”
যে দুঃখ কষ্ট লুকিয়ে রেখে শুভনিল বৃষ্টিকে নিয়ে বাঁচতে শিখেছে সেই বাঁচার মাঝে মনিকাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।মনিকা তার জীবন থেকে চলে গেছে আজ অনেক
দিন,কিন্তু আজও খুব কষ্ট হয় তার।তবু বেচে আছে বুক ভরা কষ্টের স্মৃতি নিয়ে এত গুলো বছর হলো মনিকার ফেলে যাওয়া স্মৃতি শুধুই ‘বৃষ্টির’ জন্য । মনিকাকে খোঁজ
করলে হয়তো পাওয়া যাবে , কিন্তু তাকে কি সেই অতীতের দিনগুলির মত ভালোবাসতে পারবে সে ? না সেটা সম্ভব না। আর পারবেই বা কি করে ? সময়ের সাথে সাথে
সবকিছু বদলায়,আজ শুভনিলও বদলে গেছে। সে আবার বিয়ে করেছে । বাড়িতে তার স্ত্রী আছে । সেও জানে শুভনিলের স্ত্রী মনিকা অনেক আগেই মারা গিয়েছে।
ট্রেনের জানালার পাশে শুভনিল ও বৃষ্টি বসে আছে । কেউ কারো সাথে কথা বলছে না । ট্রেন ছুটে চলেছে মনিকার শহরকে পিছনে ফেলে । শুভনিল জানালা দিয়ে বাহিরের
অন্ধকারে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ বৃষ্টি কেঁদে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,“বাবা উনি আমার মা ? তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ ,সব মিথ্যে । আমার মা বেচে
আছে ।”এই কথা বলেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। শুভনিল আর কান্না ধরে রাখতে পারলো না মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদতে লাগল।অনেকক্ষন হয়ে গেছে বৃষ্টি
বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেই আর বার বার শুধু বলছে বাবা তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছো ,সব মিথ্যে । শুভনিল মেয়েকে আর কোন উত্তর দেয়না, সে জানে মেয়ে বড়
হচ্ছে তার প্রশ্নের উত্তর সে নিজেই একদিন খুঁজে বের করবে।
সুভনিল মেয়ের মাথায় হাত রেখে আদর করে বলে, “ট্রেনটা এত ধীরে চলছে কেন ? তারাতারি বাড়ী যেতে হবে । তোমার মা তোমাকে নিয়ে চিন্তা করছে । তোমার মা
তোমাকে অনেক ভালোবাসে তাইনা মা ? ”