
সংবাদপত্রের প্রথম যুগে সংবাদ লেখার যেমন নীয়মনীতি ছিলনা তেমনি কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামোও ছিলনা। তবে সাংবাদিকেরা সাধারণ গল্প বলার মতো বা ঘটনার ধারাবাহিক বিস্তারিত বিবরণ লিখে দিতেন। আর পাঠক সমাজ তা পড়তেউ অভ্যস্ত ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে সংবাদপত্রের ব্যাপক প্রচলন, নাগরিক জীবনে মানুষের নানাবিধ ব্যস্ততা এবং যুগের চাহিদার আলোকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সংবাদের ধরন ও কাঠামো দুটোই বদলে গেল। সংবাদ এমন একটা কাঠামোতো রচনার প্রশ্ন আসলো যাতে পাঠক সহজে উপলব্দি করতে পারে। প্রথম পাঠেই সংবাদেও নির্যাসটা পেয়ে যেতে পারে। এই চিন্তার ফলে সংবাদের কাঠামো ভেঙ্গে উল্টোরুপ ধারণ করলো আর অন্যান্য কাঠামোও ক্ষেত্র বিেেশষে প্রচলিত থাকলো এবং সময়ের সাথে সাথে নতুন কিছু কাঠামোর জন্ম হলো। তবে বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য কাঠামো হলো উল্টো পিরামিড কাঠামো। হার্ড নিউজের জন্য এই কাঠামো খুবই পাঠকপ্রিয়ও বটে। সাংবাদিকতার ভাষায় খবর লেখার এ ছক হচ্ছে সংবাদ কাঠামো।
১. উল্টো পিরামিড কাঠামো
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পত্রিকার খবর লেখা হতো ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনও ধারাবাহিক ঘটনা নিয়ে। বিশেষ করে ঘটনার সহায়ক তথ্য ছিল অনুপস্থিত। খবরে লেখকের মন্তব্যও করা হতো। কিন্তু ধীরে-ধীরে সে অবস্থা বদলেছে। পত্রিকার মন্তব্য করার স্থান খবর নয়। এভাবে বদলে যেতে থাকে রীতি। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংবাদপত্রে প্রচলিত হয় উল্টোপিরামিড সংবাদ কাঠামো। এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে মূল বক্তব্য খবরের প্রারম্ভে দেয়া হবে। সূচনা হবে সারমর্মভিত্তিক। গুরুত্বের ক্রমানুসারে তথ্যগুলো আসবে। আপাতদৃষ্টিতে একটি খবরের তিনটি পর্ব।
১. সংবাদ শিরোনাম
২. সংবাদ সূচনা
৩. অবয়ব
অগ্নিকান্ড, দর্ঘটনা, যুদ্ধবিগ্
২. সেন্টিপিড সংবাদ কাঠামো
তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে পশ্চিমা দুনিয়ায় বিশেষ করে বৃটেনের সাংবাদিকরা মনে করেন উল্টোপিরামিড কাঠমো এখন সেকেলে হতে চলছে। তাই সেন্টিপিড সংবাদ কাঠামোতে সাম্প্রতিককালে সংবাদ লেখা হচ্ছে। এতে খবরের বর্ণনা এগোরে ছন্দোময় গতিতে। শুরু হবে চমৎকার ভঙ্গিতে। খবরের মাঝখানে পাঠক যেন ঝিমিয়ে না পড়ে সেজন্য বক্তব্যেও চমক ও রচনাশৈলীর থাকবে। আর শেষ প্যারায় থাকবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ()। পাঠক উদ্দীপ্ত হবে পুরো বিবরণটি পাঠককে ধরে রাখবে। তাছাড়া আজকাল কম্পিউটার প্রযুক্তির কারণে একটি রিপোর্টের যে কোনও অংশ সম্পাদনা করা এমন কিছু ব্যাপার নয়। এই সংবাদ স্টোরি-কে বাক্সময় করে তোলে।
সেন্টিপিড সংবাদ কাঠামো পদ্ধতিতে লেখা কোনও রিপোর্টে সাধারণত মাঝামাঝি বা পরের কয়েক প্যারায় কাঁচি চালানো হয়। এ পর্বে সাধারণত কারও উদ্ধৃতি, অন্যান্য বক্তব্য থাকে যা অপরিহার্য নয়। এতে প্রয়োজনে খবরের শুরু ও শেষ অংশের লাইনগুলো বাদ দেয়া হয় না। পরে কিছু জরুরি,আগ্রহোদ্দীপক তথ্য পরিবেশিত হয়। বাংলাদেশে কেউ কেউ ফিচার বা বিশেষ প্রতিবেদনগুলো এভাবে লেখে।
সেন্টিপিড কাঠামোতে ইংরেজি ভাষায় সূচনা ২৫ শব্দের কথা বলা হয়েছে। একটি বক্তব্য,যুক্তি বা ভাব থাকবে সেন্টিপিড কাঠামোর স্টোরিতে।
পরবর্তী তিন থেকে চার প্যারায় লেখা হবে অবয়ব। বিস্তারিত তথ্য এ পর্বে থাকবে। পাঠক রাশভারি কথা পড়তে চায় না। মাঝপথে কিছু আকর্ষণীয় বক্তব্য, তথ্য সংক্ষেপে দেয়া হবে। থাকবে ছোট্ট এক বাক্যে ক্ষুদ্র কাহিনী। অবশই সত্যভিত্তিক। সংযোজন করা হয় ধারালো বর্ণনা অথবা জোরালো বক্তব্য। এরপর আবার বিস্তারিত কিছু তথ্য। শেষ ভাগে যুক্তিগ্রাহ্য কিছু কথা ধীরে-ধীরে পাঠককে স্টোরি’র উপসংহারে নিয়ে যাবে। শেষ প্যারা বা বাক্য হবে তীক্ষ্ম,বক্তব্য বলিষ্ঠ। সূচনা ও শেষ অংশের মাঝে যেন মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
সেন্টিপিড কাঠামো অনুসারে লেখা স্টোরি আপন গতিতে চলবে। দীর্ঘ ও রাশভারি কথার মাঝে-মধ্যে থামতে হবে। চিত্তাকর্ষক একটি তথ্য জুড়ের দিলে কাঠামো হবে মজবুত। তবে স্টোরি’র সঙ্গে এর সঙ্গতি থাকবে। পাঠকও আগ্রহী হবে। মাঝে কাটা-কাটা বাক্য ব্যবহারের সময় অবশ্য লক্ষ্য রাখতে হয় পুরো রিপোর্ট বা অংশবিশেষের সঙ্গে এসব বাক্যের সঙ্গতি আছে কিনা।
নির্ভেজাল সংবাদ পরিবেশিত হবে সরাসরি। ফিচার, ফলো-আপ বা ঘটনার পরবর্তী সংবাদ, জীবনী, মানবিক আবেদনধর্মী
৩. স্ক্রু কাঠামো
নাম শুনেই কিছুটা ধারনা পাওয়া যেতে পারে যে এই কাঠামো কি রকম বা কিভাবে লেখা হয়। “স্ক্রু” এক নতুন ধরনের সংবাদ কাঠামো। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি বড় “স্ক্রু”বা পেরেকের মতো। প্রথমে ভারী তথ্য গুলো থোকে শেষের দিকে থাকে কম দরকারী তথ্য। তবে সেগুলো উল্টোপিরামিড কাঠামোর মত সরলভাবে আসেনা, এর গতি ও বর্ননায় রয়েছে অনেক প্যাঁচ। স্ক্রু কাঠামোতে সংবাদ সূচনা সারমর্মভিত্তিক হতে পারে। আবার হতে পারে বর্ণনাধর্মী। তবে উপরিভাগ বেশ ভারি। ঘুরে-ঘুরে বক্তব্যের শেষে পৌঁছে। স্ক্রু রিপোর্টে একই বাক্যে অথবা প্যারায় দু’টো তথ্য সন্নিবেশ করা হয়। লেখার গাঁথুনি খুবই মজবুত হতে হয়। স্ক্রু কাঠামোর শেষভাগে তত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে না। শুধুমাত্র দক্ষ রিপোর্টারই পারেন এমন স্টোরি লিখতে। এসব রিপোর্টের পাঠকও হয় অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত।
৪. ডায়মন্ড সংবাদ কাঠামো
ডায়মন্ড কাঠামো স্কু কাঠামোর মতো একটি জটিল কাঠামো। এই কাঠামোতে সংবাদ পরিবেশন করার জন্য লেখার হাত হতে হবে ভালো। ডায়মন্ড স্টোরি’র বৈশিষ্ট্য হলো শুরুতে চলমান কিছু তথ্য, মাঝে সুদূর অতীত শেষে আবার বর্তমান সময়ের বিবরণ দেয়া হয়। শুরু ও শেষে একই বিষয়, প্রসঙ্গ,ভাব, অর্থাৎ একই ব্যক্তির প্রসঙ্গ থাকবে। মাঝখানে কিছু উদৃতি বা কিছু সম্পূরক তথ্য । শুরু ও শেষে জোরালো বক্তব্য থাকবে জোরালো গুরুত্বপূর্ণ। ডায়মন্ড কাঠামো সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ ম্যাগাজিনে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে“টাইম” ও “নিউজউইক”-এ এ স্টাইল লক্ষ্য করার মতো।
বিষয়ের একটি অংশ দিয়ে শুরু। স্টোরি ধীরে-ধীরে এগোবে। মধ্যভাগে জটিল বিষয়ের অবতারণা। এরপর বিস্তারিত তথ্য।
এ কাঠামোতে কতকগুলো প্রাসঙ্গিক তথ্য থাকবে ভাগ-ভাগ করে তথ্য পরিবেশন করা হবে। শেষ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করা হবে।
৫. বর্ণনাধর্মী সংবাদ
কিছু বর্ণনাধর্মী খবরও পত্র পত্রিকায় দেখা যায়। অনেকে মনে করেন টেলিভিশনে যে সচিত্র বিবরণ শ্রোতা/দর্শক দেখেন এরপর সাদামাটা বর্ণনা তিনি পত্রিকায় পড়তে আগ্রহী হন না সেজন্য এমন বর্ণনা পরিবেশন করা হয় যা পাঠকের কৌতুহল মেটাতে পারে। এখানে বর্ণনায় কিছু আবেগ ও উপমা থাকতে পারে। এটা পুরনো নিয়ম। বা সাধারণ ঘটনা লিপিব্ধ্ করার মতো। তবে কিছু পাঠক টানার মতো ব্যাপার থাকতে হয়। িএ সংবাদ লম্বা হয়। ফলোআপ সংবাদ, বাখ্যাধর্ সংবাদ, ডেপথ নিউজে এ ধরনের ফমূলা ব্যবহার করা হয়। কোন ধরনের সংবাদ বর্ণানাধর্ হবে এবং কোন সময়ে হবে। এটা বোঝার মতো ক্ষমতা সাংবিাদিকের থাকতে হবে।
৬. ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কাঠামো বা কেস স্টাডি বেজড কাঠামো
এই কাঠামো বেশ সুখপাঠ্য এবং পাঠককে খুব সহজে বিষয়ে গভীওে নিয়ে যায়। এতে গল্পের পাশাপাশি ঘটনার সাথে জড়িত চরিত্রের সাথেও পাঠওে পরিচয় ঘটে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকার নতুন এক ধরনের সংবাদ কাঠামো ব্যবহার শুরু করেছে। সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উন্নয়ন, সরকারি কর্মকা- ও অন্যান্য জটিল বিষয়ে লেখার সময় এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তাত্বিক বিষয়গুলোকে হুদয়গ্রাজ্য কওে তোলার এটা একটা কৌশলমাত্র। আর একজন সংবাদকমী সততার মধ্যে থেকে তার সংবাদকে পাঠকপ্রিয় করে তোলার পুরোপুরি অধিকার রাখে।
একটি স্টোরি’র শুরুতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ প্যারায় একজন ব্যক্তি অথবা তার পরিবারের কথা বলা হয়। কিছুটা পটভ’মি,সমস্যা এবং সমষ্যার প্রভাব এইসব। তারপর ধীরে-ধীরে এগুতে থাকে মূল বক্তব্য বা ঘটনার দিকে। ব্যক্তির সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা বাণিজ্যের যোগসূত্র স্থাপন করা হয়। দেখা যায় সমস্যা মূলত অভিন্ন। শেষে দু’ থেকে চার প্যারায় পুনরায় ওই ব্যক্তি অথবা অন্য কোনও ব্যক্তির কথা বলা হয়। যার বা যাদের প্রসঙ্গ শুরুতে ছিল। শেষে ব্যক্তির সাফল্য অথবা ব্যর্থতা বিবৃত হয় স্টোরিতে। অনেক সময় সফলতার গল্পগুলো এভাবে তুলে ধরা হয়। এবং ফলোআপ নিউজের ক্ষেত্রে অনেকে এই ফর্মূলাটা ব্যবহার করেন।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, সাতখিরায় সরকারী বাহিনী অত্যাচারে কিভাবে মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, সেটা বোঝানোর জন্য একজন নারীর নির্যাতন বাড়িঘর হারানো ইত্যাদি কেস স্টাডি হিসেবে তুলে ধরে পরে ঘটনার বিস্তারিত অংশে যাওয়া য়ায়
৭. সংবাদ কাঠামো “মিশ্রধরণ”
সাধারণত ডায়মন্ড বা নিউজ ম্যাগাজিন কাঠামোর পরিবর্তিত রূপ হচ্ছে এ পদ্ধতি। অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টিংয়ে ‘মিশ্র ধরণ’সংবাদ কাঠামো প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৮১ সালে “দ্য টেক্সাস অবজারভার” পত্রিকায়। এটা আসলে সুনিদিষ্ট কোনো কাঠামো নয়। আপনি যখন কোনো কাঠামো অনুসরণ করবেন না। অথবা আপনার লেখা বিভিন্ন কাঠামোরন সাথে একটুৃ একটু মিল আছে তখন একে মিশ্র কাঠামো বলা হয়ে থাকে। কারো মতে সংবাদের এক অংশ এক ধরনের কাঠামো অনুসারে লিখলে সেটাকে মিশ্র কাঠামো বলা যেতেই পারে।
এ পদ্ধতিতে বৈশিষ্ট্য হলো ধারাবাহিকভাবে ডায়েরিতে যেভাবে ঘটনাপঞ্জি লিখে রাখা হয় স্টোরি শুরু হয় সেভাবে। রিপোর্টার যা প্রত্যক্ষ করেন তার বিবরণ ডায়েরি’র পাতার দিনক্ষণ অনুযায়ী একে-একে বিন্যস্ত করে যান।
আজকাল দক্ষ কর্মীগণ বিভিন্ন কাঠামো পরীক্ষা নিরাীক্ষার পর পাঠককে ভিন্ন স্বাদ দিতে বিচিত্র ও বিভিন্নভাবে সংবাদ রচনা করেন। এতে কেউ সফল হন আবার কেই হন না। আপনি যদি খুব ভালো একাডেমিক জ্ঞান আর দক্ষ লেখক বা সাংবাদিক হন। আপনিও সেটা চেস্টা করে দেখতে পারেন। নচেত ন্যাড়া মাথায় বেলতলায় না যাওয়াই ভালো। আপনি নতুন কিংবা অনিয়মিত সাংবাদিক হলে আপনি বরং নিয়মনীতি অনুসারে সংবাদ রচনা করুন তাতে আহামরি কিছু না হলেও অন্তত সংবাদের প্রয়োজনীয় গুনাগুন অন্তত ঠিক থাকবে।