
মুহাম্মদ মুনির হাসান, সিলেটের :
দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ হিসেবে পরিচিত সৃষ্টি কর্তা কতৃক নির্মিত এই পূন্যে ভূমি সিলেটকে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের এক আধ্যাত্মিক রাজধানী। যেখানে বছরের অনেকটা সময় জুরে থাকে রোদ আর বৃষ্টির মিলন।এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘেরা অপরূপ মনোমুগ্ধোকর দৃশ্যগুলি যেন অনেকেরই অজানা।আর তাই বুঝি এই সিলেটকেই বেঁছে নিয়েছিলেন অনেক পীর,সাধু ও আওলিয়ারা। যেখানে বসেই তারা ধর্মীয় জ্ঞান চর্চা করেছিলেন, আর সেই ধ্যান আর তপস্যার মাধ্যমে অনেক শিক্ষা গ্রহন করে এই এলাকার মানুষদের কাছে ধর্মীয় অনুভূতি আরো ব্যাপক ভাবে প্রচার করেছিলেন।যাই হোক বলছি সিলেটের বিছানাকান্দির কথা। বিছানাকান্দি ছাড়াও রয়েছে জাফলং, রাতারগুল, লোভাছড়া, পান্তুমাই, লালাখাল,হাম-হাম সহ আরো প্রভৃতি নয়নাভিরাম দর্শনীয় স্থান।সত্যিই মহান সৃষ্টিকর্তার এযেন এক অপরুপ সৃষ্টি। এসব দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে নব উদ্ভাবিত দর্শনীয় একটি স্থান বিছানাকান্দি অন্যতম বলে মনে করেন পর্যটকরা।
বিছানাকান্দি সিলেট শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা পর্যটনকেন্দ্র এটি। পাথর বিছানো বিস্তীর্ণ প্রান্তরের ওপর বয়ে চলা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি ঝর্ণা আরো আকর্ষনীয় করে তোলে বিছানাকান্দির এই অপরুপ দৃশ্য।বলতে গেলে জাফলংয়ের সাথে বিছানাকান্দির অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায় এখানে এসে, তবে বিছানাকান্দির পানি জাফলংয়ের চেয়েও স্বচ্ছ বলে মনে হয় অনেকের কাছে । পানিতে বসে ছবি তুললে তা পানির নিচের পাথর গুলো ধরা পরে ক্যামেরার লেন্সে।নিচ থেকে দেখলে মনে হবে পাহাড়ের ঢালুতে থাকা দিগন্ত জোরা গাছ গুলো আকাশ ছুঁয়েছে।পাহাড়ের কোলে এ যেন পৃথিবীর এক অপরূপ বিছানা। হ্যাঁ, বিছানাকান্দি সত্যিই জান্নাতি এক বিছানা বলে মনে হবে সবার কাছেই। বর্তমানে সিলেটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হল এই অপরূপ বিছানাকান্দি।এই বিছানাকান্দিতে ভ্রমণের মাধ্যমে আপনিও হারিয়ে যেতে পারেন সৌন্দর্যের অপরূপ এক আঁধার রাজ্যে।অনেক অপেক্ষার পরেও যদি কোন দিন হাতে সময় হয় তাহলে দেখে যেতে পারেন এই ঝর্না বেষ্ঠিত অপরূপ সৌন্দর্যের লিলা ভূমি। ঢাকা থেকে যদি আপনার গন্তব্যের পথ হয় তাহলে আপনি সায়দাবাদ,কিংবা গাবতলী থেকে হানিফ,শ্যামলী,সোহাগ,ইউনিক,পরিবহনকেই বেঁছে নিতে পারেন আপনার ভ্রমণের জন্য।তবে চাইলে ট্রেনেও যাত্রা করতে পারেন আপনি।সিলেট গামী ঢাকার কমলাপুর কিংবা বিমান বন্দর থেকে জয়ন্তিকা,কালনী এক্সপ্রেসে ট্রেনের সিডিউল অনুযায়ী চলে আসতে পারেন এখানে।বলে রাখি ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব প্রায় ২৪৩ কিলোমিটার, আবার সিলেট থেকে বিছানাকান্দির দূরত্ব আরও প্রায় ৫৬-৫৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ঢাকা থেকে বিছানাকান্দিতে যেতে আপনার ৩০০ কিলোমিটারের পথ অতিক্রম করতে হবে। ঘঁড়ির কাঁটা অনুযায়ী সকালের নাস্তা সেরে যদি আপনি ৬টা বাঁজেও বের হোন তাহলেও হয়তো অনেকটা লেট হয়ে যাবে তাই রাতের বেলাই ভ্রমন করতে পারলে ভাল।ঢাকা থেকে প্রায় আপনার গন্তব্যে বিছানাকান্দিতে পৌঁছাতে সময় লাগবে আনুমানিক ৬ থেকে ৭ ঘন্টা। যদি সকালের দিকেও বের হোন তাহলে গাড়ি যখন ছুঁটবে আপনার গন্তব্যের পথে,তখন দেখতে পাবেন রাস্তার চারিদিকে সবুজ ধান ক্ষেতের অপরুপ দৃশ্য আর অসাধারন বাংলার প্রতিচ্ছবি।রাস্তায় যেতে যেতে গুন গুনিয়ে গানও গাইতে পারেন “চলো না ঘুরে আসি অজানাতে যেখানে নদী এসে থেমে গেছে”।দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আপনি যখন পৌঁছবেন বিছানাকান্দিতে তখন সত্যি মনে হবে এযেন এক পাহাড়ি রাজ্যে চলে এসেছেন আপনি,যেখানে মেঘ,পাহাড়,আর ঝর্না এক সাথে আপন মিতালীতে খেলা করছে। বলে দিতে চাই বিছানাকান্দিতে ভ্রমণের আগেই নিকটস্থ হালদারপার বাজারে বসে কাছে থাকা সকালের নাস্তা সেরে ফেলতে পারেন পুরো পরিবারে কিংবা সংগে থাকা আপনার আপনজনের সাথে। হালদারপার বাজার থেকে বিছানাকান্দি স্পটের দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার।
তবে দুপুরের পরেই সেখানে রওনা দেওয়া ভাল স্পটের উদ্দেশে,কারন তখন অনেকটা রোদ পরে যায়।আর স্পটে যেতে হলে অবশ্যই আপনাকে হেঁটেই যেতে হবে,কারন সেখানে আঁকাবাকা পথ। হাঁটতে হাঁটতে আপনার ছোট বেলার সেই কবিতাও মনে পড়ে যেতে পারে “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে, পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি, দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি” ছোটবেলার কবিতার সাথে ছবির অনেক মিল খুঁযে পাবেন এখানে আসলে।
হাঁটতে হাঁটতে আপনার গন্তব্যে যখন পৌঁছে যাবেন তখন আপনি থাকবেন বাংলাদেশের শেষপ্রান্তে।এতো সুন্দর!! খুশিতে সাত–পাঁচ না ভেবেই নেমে যেতে ইচ্ছা করবে অবিরাম স্রোতের পাথর ঘেরা বেষ্ঠিত ঝর্নার পানিতে।হুম ধপাশ করে পাথরে আছাড় না খেতে চাইলে সাবধান থাকুন।যদি কখনো লেগেই যায় কোন কারনে তাহলে শীতল জলের পরশ পেয়ে আছাড়ের ব্যথা ভূলেই যাবেন সেটা জানি।সাথে দুই কিলোমিটার বন্ধুর কিংবা পরিবারের সাথে পথহাঁটার ক্লান্তি ভুলে যাবেন সুন্দর সূশীতল বাঁতাস আর পায়ের নিচে ঠান্ডা পানি পেয়ে।
যখন টানা এক ঘন্টা যাবৎ হেঁটে আপনি ক্লান্ত অনূভব করছেন তখন আপনার শরীরের তাপকে একটু খানি কমিয়ে নিতে বিছিয়ে দিতে পারেন ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঝর্ণার ঝকঝকে পরিষ্কার শীতল পানিতে, তখন সেই ক্লান্তি অতিসুখে পরিণত হতে এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না। কিভাবে যে এতটা পথ হেঁটেছেন, বুঝতেই পারবেন না। চাইলে নৌকায়ও যেতে পারেন কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের কি আর নৌকায় ভালো লাগে! ঝকঝকে শীতল পানির প্রবল স্রোত আর ঢেউয়ে, বড় বড় পাথর আঁকড়ে ধরে শৈবাল। সামনে সবুজে ঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড়। দূরের পাহাড়টা এতই উঁচু, দেখে মনে হয় যেন মেঘ ছুঁয়ে আছে। পাহাড়ের চূড়া থেকে বিরামহীনভাবে গড়িয়ে পড়ছে ঝর্ণার পানি আর তার শব্দে সারা শরীর যেন নেচে ওঠে বারং-বার। এ যেন নায়াগ্রা জলপ্রপাতেরই একটা বড় অংশের প্রতিচ্ছবি।প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যের মহিমা, সত্যিই অবর্ণনীয়। এ যেন অদ্ভুত এক ভালোলাগা। সবকিছু এখানে এসে মিলেছে। জাফলংয়ের স্বচ্ছ পানি, পাথর আর পাহাড়ের মিলন। তার সাথে আছে মাধবকুন্ডের মতো ঝর্ণা। কক্সবাজারের মতো জলের ঢেউ আর শীতল মিষ্টি পানি। এ যেন ভূ–স্বর্গ।
এখানে এসে সব সৌন্দর্যই উপভোগ করবেন কিন্তু ছুঁতে পারবেন না কিছুই, কেননা সবই যে ভারতে। তবে দূর পাহাড়ই আপনাকে হাঁটাবে প্রতিনিয়তই। মেঘালয়ের টানেই আপনি হাঁটবেন। যদি হেঁটে বিছানাকান্দি যান তাহলে আপনাকে এরকম কয়েকবার নৌকা দিয়ে পার হতে হবে। হাঁটতে হাঁটতেই হয়তো চোখে পড়বে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর একটি অফিস/ক্যাম্প। যা সীমান্তের একদম শেষ মাথায়। বিছানাকান্দি নামার আগে অবশ্যই তাদের সাথে পরামর্শ ও অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।
বালু ও পাথরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে আপনাদের অনেকেরই বিরক্তি চলে আসতে পারে। তবে স্পটে পৌঁছার পর বিরক্তি অবশান হবে তা-জানি।অতঃপর নামতে পারেন ঝরনার পানিতে। প্রান খুলে হয়তো বলতে ইচ্ছে করবে স্রোষ্টার সৃষ্টি কত অপরূপ। এই সৌন্দর্য মুহূর্তের মধ্যেই আপনার মনকে সতেজ করে দিবে। কেটে যাবে আপনার সকল ক্লান্তি। হয়ত,কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করবেন সৃষ্টি কর্তার দরবারে। যার করুণায় এতো সুন্দর একটি স্থানে আসতে পেরেছেন বলে। মন ভরে গোসল আর ঝরনার পানিতে মাতা-মাতি যেন আপনার দেহ ও মনকে ক্ষনিকের জন্য হাড়িয়ে নিয়ে যাবে কল্পনার রাজ্যে। আপনার একটু খানি দুষ্টুমিতেও মেতে উঠতে পারে পুরো পর্যটন স্পটটি ।এরপর তো ঝরনার পানিতে ছবি তোলা থাকছেই।কেউ আবার সেলফি আবার, কেউ কেউ গ্রুপ ছবি তোলায় মত্য।এবার ফেরার পালা। এভাবে সন্ধার আগ মুহূত্ত পর্যন্ত আপনি উপভোগ করতে পারেন এখানকার সব মধুর দৃশ্যগুলি।সন্ধা নামার আগেই আবার আপনাকে হাঁটা শুরু করতে হবে।কারন এটাই এখানকার প্রশাসনের নিয়ম।কারন সন্ধা নামলেই বখাটেদের চলাফেরা বেড়ে যায় এখানে,আর তাইতো এই নির্দেশ প্রশাসনের যাতে করে কোন পর্যটকের কোন ধরনের অসুবিধা না হয়। ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে আবারো হালদারপার বাজারে আসতে হবে আপনাকে। যেখানে আপনি সকালের নাস্তা খেয়েছিলেন মনে আছে কি? রাত হবার আগেই ফিরতে হবে, প্রশাসনের আদেশ তাই ফিরতে ফিরতে হয়তো সূর্য তখন ডুবুডুবু অবস্থায় থাকবে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর যখন আপনি হালদারপার বাজারে। তখন প্রায় সন্ধেই হয়ে যাবে,যদি মাগরিবের সময় হয় তাহলে পাশের মসজিদ থেকে সুমধুর কণ্ঠে আপনার কানে ভেসে আসবে মাগরিবের আজান। মুসলিম অভিযাত্রীরা বাজারের মসজিদে সালাতুল মাগরিব আদায় করে আবার ফেরার উদ্যেশ্যে গাড়িতে উঠতে পারেন। সারা দিনের দৌড়ঝাঁপের কারণে সবার মধ্যেই একটা ক্লান্তিভাব থাকবে। অনেকটা নীরবেই কেটে যাবে কিছু সময়। এরপর আপনাকে আসতে হবে সিলেট শহরে। বাস থেকে নেমে হালকা নাশতা করতে পারেন। অবশ্য চা পানের অভ্যাস যাদের আছে তারা একটু খানি চা কিংবা কফি পান করে নিতে পারেন। এরপর মনে হয়তো কিছুটা চেতনা ফিরে পাবেন।এভাবেই ভালই ভালই চলে আসতে পারেন বিয়ানীবাজার,সুনামগঞ্জ,মৌলভীবাজার,শ্রীমঙ্গল,হবিগঞ্জ হয়ে আবার সেই চিরচেনা কেন্দ্র বিন্দু ঢাকা কিংবা অন্য কোন এলাকায়। রাস্তায় আসতে আসতে হয়তো খানিকটা স্নৃতি মনে পড়বে,কিন্তু কি’ইবা আর করার এটাই যে বাস্তবতা। কিন্তু মন যেন পড়ে রইল বিছনাকান্দির পরম শীতল স্বচ্ছ পানিতে!
মুহাম্মদ মুনির হাসান
সিলেট থেকে ফিরে,
মোবাইলঃ০১৭৩৬-৮০৬২৩০