নয়া আলো– প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কেবল ভূমি সংস্কার ব্যতীত পার্বত্য শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী চারটি ব্রিগেড ব্যতীত অধিকাংশ সেনা ক্যাম্পও সরিয়ে নেয়া হয়েছে। গতকাল সকালে রাজধানীর বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাবের পার্শ্ববর্তী স্থানে নির্দিষ্ট দুই একর জমির ওপর পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণের ভিত্তিফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। সেনা ক্যাম্পগুলো অধিকাংশই তুলে নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যা সামান্য কিছু আছে- চারটি জায়গায় কেবল ৪টি ব্রিগেড থাকবে। বাকিগুলো সব সরিয়ে নেয়া হবে। যে জন্য রামুতে আমরা একটা সেনানিবাস করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন-২০০১ এর কতিপয় সংশোধনীর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সম্ভব সবকিছু করতেই সরকার প্রস্তুত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরাও বাংলাদেশের নাগরিক। সুতরাং সরকার ওই অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎখাত এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এমপি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন,চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। প্রায় দুই একর জমির ওপর নির্মাণাধীন এই পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স প্রকল্পে ৬ তলা ভবন, মাল্টি পারপাস হল, ডরমেটরি, প্রশাসনিক ভবন, জাদুঘর, লাইব্রেরি, ডিসপ্লে সেন্টার, থিয়েটার হল, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর বাসভবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের বাসভবন থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭০ সালে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে এই এলাকার ভূ-বৈচিত্র্য, নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং সেখানে বসবাসকারী নানা সম্প্রদায়ের বিষয়ে জানার সুযোগ হয়। যা তাকে এ অঞ্চলের জনগণের কল্যাণে কার্যক্রম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের সব জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতের সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যেই আমরা শান্তিচুক্তি করি। যে চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সৃষ্ট দু’দশকের বেশি সময় ধরে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর অনেক সরকারি দপ্তর পার্বত্য এলাকায় স্থাপিত হয়েছে, বেড়েছে কাজের সুযোগ। পার্বত্যবাসীর জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। ঢাকা ও অন্যান্য শহরে পার্বত্যবাসীর যাতায়াত বেড়েছে। ঢাকায় অবস্থানের জন্য এতদিন তাদের নিজস্ব কোনো ভবন ছিল না। রাজধানীতে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটি ঠিকানা করে দেয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স’ নির্মাণের জন্য বেইলি রোডে দুই একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়।
এ কমপ্লেক্সে এসে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যেন বুঝতে পারে, এটাই তাদের এলাকা। সেভাবেই এই কমপ্লেক্স করা হচ্ছে উল্লেখ করে কমপ্লেক্সটির কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত গণপূর্ত মন্ত্রীর প্রতিও তিনি তাগিদ দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, শান্তিচুক্তির স্বাক্ষরের পর আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পার্বত্যবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তিনটি পার্বত্য জেলায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ১ হাজার ৩৬৯ কি.মি. রাস্তা হচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলায় ৮৭৩ কি. মি. বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ ও প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য ৮৭৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কারিগরি প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। থ্রিজি সুবিধাসহ মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাহাড়ি জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে রাঙ্গামাটিতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্নয়ন কৌশল ও অগ্রাধিকার নির্ধারণের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদি উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়নেও কাজ করছি। এ অঞ্চলে পর্যটকরা যেন আরো বেশি আকৃষ্ট হন, সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পার্বত্য জনগণের শিক্ষার প্রসারে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে মাতৃভাষার শিক্ষাদানের জন্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় বর্ণমালা সংরক্ষণ এবং নিজ নিজ ভাষায় শিক্ষাদানের কাজ শুরু হয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকায় হোস্টেলসহ পর্যাপ্ত সংখ্যক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় স্থাপন হবে। দুর্গম এই এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হলেই তা আবাসিক প্রতিষ্ঠান হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম এলাকায় প্রশাসনিক ও উন্নয়ন সমন্বয়ের সুবিধার্থে আমরা নতুন উপজেলা ও ইউনিয়ন গঠন করবো। ইতোমধ্যে একটি নতুন উপজেলা গুইমাড়া, একটি নতুন থানা সাজেক, একটি নতুন ইউনিয়ন বড়থলি গঠন করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তিচুক্তি হলেও ২০০১ বিএনপি ক্ষমতায় এসে পার্বত্য অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক দেয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কের ব্যবস্থা করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছি। জিডিপি ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। উন্নয়নের এই অভিযাত্রায় আমি পার্বত্যবাসীকেও একই গতিতে শামিল করতে চাই। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অংশে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।