ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অফুরান সম্পদে সমৃদ্ধ জনপদ ঝিনাইদহ। খেজুরের গুড়, কলা-পানের প্রাচুর্যমণ্ডিত ঝিনাইদহের রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। প্রকৃতির সজীবতা এবং প্রাণজুড়ানো আবহাওয়া ছাড়াও এই জেলায় রয়েছে চমৎকার প্রাচীন মসজিদ, মন্দির এবং প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর বিভিন্ন ভবন। আর তা যদি হয় প্রাচীন পুরাকীর্তি বা জমিদারবাড়ি, তবে তো কথা–ই নেই। যান্ত্রিক জীবনে শতব্যস্ততার বাইরে ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য আদর্শ ভ্রমণ স্থান হতে পারে ঝিনাইদহের মিয়ার দালান। যার দেয়ালের পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া। বাড়িটি ঝিনাইদহের অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান। ভবনটির নির্মাতা চমৎকারভাবে দেয়ালের গায়ে খোদায় করে নানান রকম কারুকার্য ফুটিয়ে তুলেছেন। যা অতি চমকপ্রদ। মিয়ার দালান ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত একটি পুরোনো জমিদারবাড়ি। এটি নবগঙ্গা নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত। ঝিনাইদহ শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। যত দূর জানা যায়, ১২২৯ বঙ্গাব্দে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু করেন তত্কালীন জমিদার সলিমুল্লাহ চৌধুরী। ৭৫ হাজার টাকা ব্যয়ে বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১২৩৬ বঙ্গাব্দে। সলিমুল্লাহ চৌধুরী স্থানীয় লোকজনের কাছে মিয়া সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। সে জন্য বাড়িটি মিয়ার দালান বলে পরিচিতি পায়। তবে যে জমিদার এই দালানটি নির্মাণ করেন তিনি ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় ভবনটি কিনে নেন সেলিম চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি। তাই ভবনটিকে স্থানীয়ভাবে কেউ কেউ সেলিম চৌধুরীর বাড়িও বলে থাকে। কথিত আছে, সলিমুল্লাহ চৌধুরীর পিতা বধুই বিশ্বাস ছিলেন নলডাঙ্গা রাজবংশের দেওয়ান। বধুই বিশ্বাসের মৃত্যুর পর সলিমুল্লাহ নলডাঙ্গা রাজবংশের কর্মচারী হিসেবে যথেষ্ট উন্নতি করেন এবং তাঁকে চৌধুরী উপাধি দেওয়া হয়। তিনি মুরারী নামে এক হিন্দু রমণীর প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন। পরবর্তী সময়ে ওই নারীর নাম পরিবর্তন করে বিবি আশরাফুন্নেসা রাখা হয়। মিয়ার দালানের প্রধান ফটকে খোদাই করা লেখায় তাঁর কথাসহ নির্মাণের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। তাতে লেখা আছে, ‘শ্রীশ্রী রাম, মুরারীদহ গ্রাম ধাম, বিবি আশরাফুন্নেসা নাম, কী কহিবা হুরির বাথান। ইন্দ্রের অমরাপুর নবগঙ্গার উত্তর ধার, ৭৫,০০০ টাকায় করিলাম নির্মাণ। এ দেশে কাহার সাধ্য বাধিয়া জল মাঝে কমল সমান। কলিকাতার রাজ চন্দ্র রাজ, ১২২৯ সালে শুরু করি কাজ, ১২৩৬ সালে সমাপ্ত দালান।’ বলা হয়ে থাকে, বাড়িটি থেকে নবগঙ্গা নদীর নিচ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ ছিল। সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ এখনো চিহ্নিত করা যায়। নদীতে যেভাবে বাধ দিয়ে ইমারতটি নির্মাণ করা হয়েছিল, সেভাবে তৈরি আর কোনো পুরোনো ইমারত ঝিনাইদহ শহরে দেখা যায় না। বাড়িটির ব্যাপক পরিচিতির একটি বড় কারণ একটি বিশেষ খেজুরগাছ। যে গাছটিতে একাধিক মাথা ছিল এবং প্রতিটি মাথা থেকেই রস আহরণ করা যেত। তবে এখন আর খেজুরগাছটি নেই। বাড়িটি দেখলে মনে হয় নদীগর্ভে দাঁড়িয়ে আছে। চুন-সুরকির সঙ্গে ইটের গাঁথুনির এ বাড়িটির দেয়াল ২৫ ইঞ্চি পুরু। উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য প্রায় ৮২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৬৬ ফুট। এ ভবনে ছোট-বড় ১৬টি কক্ষ রয়েছে। দ্বিতীয় তলার ছাদের ওপর রয়েছে একটি চিলেকোঠা। শ্বেতপাথর দিয়ে আচ্ছাদিত এই চিলেকোঠা নামাজঘর হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। তবে সংরক্ষণ আর তদারকির অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ২০০ বছর আগে নির্মিত এই মিয়ার দালান। কয়েক বছর আগেও এ স্থাপত্য দেখতে দর্শনার্থীরা ভিড় করলেও এখন কেউ সেদিকে পা বাড়ান না। যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে এ স্থাপনা হয়ে উঠতে পারে ঐতিহ্যপিপাসু লোকের কাছে অতিব নৈসর্গিক একটি স্থান ও পর্যটনকেন্দ্র।