শীতের দুঃখ
রুমানা আক্তার রত্না।
একদিন শীতের সকালে আমরা চার জন্য ক্যাম্পাসে বসে আছি। শীতের সময় বেলা সাড়ে নয়টা তবুও সূর্যের আলোর দেখা নেই। ওসাকা রিফাত সুনীল আর আমি। ওসাকা রিফাতকে বললো এখনো ক্যাম্পাসে ভাপা পিঠা বিক্রি হচ্ছে যা কিনে নিয়ে আয় আমার সবাই খাবে। শীতের ভাপা পিঠা মানেই অন্য রকম স্বাদ।শীতের মতো ঋতুই হয় না। এই ঋতুতে খাওয়ার সেই মজা। কত কিছু পাওয়া যায়। অতিথি পাখির ভিড় জমে বিলগুলোতে বেশ ভালো লাগে তাই না রে। রিফাত বললো হুম শুধু কী তাই এতো সুন্দর সুন্দর শীতের পোশাক মানুষ পরে সেই সুন্দর লাগে। আমারতো মনে হয় শীতঋতুতে সবার গুনাহও কম হয় কী বলিস? হুম কথা মন্দ বলিসনি। আজ কাল যে পোশাক পরে মেয়েরা রাস্তায় চলাচল করে চোখ কে হেফাজত করায় কঠিন। তবে শীত কালে সবাই শালীনতার মধ্যে থাকে। আমার তিন জন এসব নিয়ে হাসা হাসি করছিলাম ঠিক তখনি সুনীল বলে উঠলো শীত আমার কখনোই প্রিয় ঋতু ছিলো না।
আমার বুদ্ধি হওয়ার পরে থেকেই শীতঋতু আমার অপ্রিয়। শীতকে ঘিরে মানুষের জীবনে এতো এতো দুঃখ আমি অন্য ঋতুতে দেখিনি। কেমন একটা হাহাকার মার্কা একটা সময় শীতকাল। গাছ গুলো পাতা শূন্য। শ্রমিকের কাজ নেই।এই ঋতু মানুষকে অলস করে দেয় একদম। চারিদিকে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মানুষ গুলো ঠান্ডা জর কাঁশি গলাব্যথা আরো কত কী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে । বাচ্চার প্রাণ ভরে আনন্দে করে খেলতে পারে না। ঘর থেকে মায়েরা বাইরে যেতে দেয় না। আর সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলছে এই ঘন কুয়াশার কারণে। কত পরিবার স্বজন হারা হয় এই শীতে শুধু কুয়াশাকে কেন্দ্রকরে। আরো জানিস সেই দিন স্টেশনে সন্ধ্যার সময় ঘন্টা খানিক বসে ছিলাম। তখন চোখে পরলো ভিক্ষুক মুক্ত জেলা আমাদের কুষ্টিয়া একটা সাইনবোড লেখা আর সেই লেখার নিচে বসে আছে শীতে কাঁতর হয়ে বস্তা নিয়ে শুয়ে রাত কাটানো কত মানুষ। একটা বাচ্চার আবদার শুনে হৃদয় ভেঙে কান্না আসতে লাগলো তার মার কাছে বলে মানুষ কত সুন্দর সুন্দর শীতের পোশাক কিনে পড়ে আর তুমি আমাকে কিছু কিনে দাওনা। খালি বলো আগামী বার কিনে দিবে। তোমার আগামী বার আসেনা কেনো মা। আর কত দিন বস্তার মাঝখানে শুয়ে আর কত সকাল এই বস্তা গাঁয়ে দিলে তোমার আগামী বার আসবে। মা চোখ মুছতে মুছতে বললো আমার টাকা নাইরে বাপ।
তোরে তো কত কিছু দিতে ইচ্ছে করে আমি দিতে পারিনা। আমাদের তিন বেলার পরিবতে দুই বেলা খাওন জুটাতেই জান আর জান থাকে না। কেমনে কিনে দেবো তোরে নতুন শীতের পোশাক। এক জন রাজমিস্ত্রীকে দেখলাম ঘন কুয়াশার কারণ তার চার দিন কাজ বন্ধ বাসায় খাবার নেই সন্তান অসুস্থ। মাঠের কাজে গেলে তাকে তিনশো টাকা দেওয়। সেখানে চাউলের কেজি ৬৫ টাকা সবজি ঠিক মতো কেনা হয় না। তার উপর পাশের বাড়ির মানুষের পিঠা খাওয়ার ধুম লেগেই থাকে। যেখানে তেল কেনা গেলেও খেজুরের গুর আর চিনি কেনা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া কিছু না। শীত আসার আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয় এবার শীতে শীতের পোশাক কিনতে হবে নিজের জন্য না হলেও ছেলে মেয়ে দের জন্য। অথচ এই ঋতু আর বর্ষা ঋতুতে মানুষ বেশি বেকার থাকে। এসময় মানুষের টাকা পয়সার প্রয়েজন বেশি হয়। শীতের দীর্ঘ রজনী হওয়া অসুস্থ মানুষ গুলোর রাত কাটেনা। আল্লাহ দুনিয়ায় যত পরিক্ষা আছে সব শীতকালে মানে ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলে। এসময় লেখা যায় তোরাই বল। এক জন কৃষক তাঁর চাষের ফুলকপি পালংশাক কাটে সেই ভোরবেলা বাজার জাত করার জন্য কিন্তু এই সময় ফুলকপি পালংশাকের যে দাম তা দিয়ে কৃষকের প্যারাসিটামল কিনার টাকায় থাকে না দিন শেষে। কিছু মানুষ ঠিক মতো গোসল করতে না পারার জন্য বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। এতো এতো খারাপ দিক থাকতেও শুধু তোরাই না অনেক মানুষ বলবে শীত আমার প্রিয় ঋতু।
তোদের যে শীত কীভাবে প্রিয় হয় আমি বুঝি না রে ভাই। আসলে তোরা উচ্চবৃত্ত বলেই শীত তোদের ভালো লাগে। আমার তো মোটেই ভালো লাগে না। আমি প্রতিটা দিন ভাবি কবে যাবে এই শীত। আমার গায়ে এই সুয়েটার আমি চার বছর আগে কিনছি আর ঐ চাদরটা আমার ছয় বছর আগে কেনা। শীত আসলেই আমাদের মত মধ্যবৃত্তদের ভয় হয় বুঝলি।আমার সমাজের মানুষকে না পারি সাহায্য করতে না পারি কারো থেকে কোনো সাহায্য নিতে। বড় লোক মানুষ গুলোর কাছে শীত মানে এক মহা উৎসব। তারা নিজেরা যা ব্যবহার করে আজ পর্যন্ত দেখেছিস তেমন পোশাক অসহায়দের দিতে। তারা লোকগুলোকে শীতবস্ত্র বিতরণ করে শুধু সেলফি তুলে পোস্ট করে পেজের মান বাড়াতে নয়তো গ্রামে নাম ডাক কিনতে। গত শীতে এই কম্বল নিয়ে মারামারি লাগায় একট ব্যাক্তি গুরুতর আহত হয়েছিল।
তাছাড়া জেলা উপজেলা চেয়ারম্যানরা যে শীতের কম্বল বিতরণ করার জন্য দেয় তা গ্রামে আসতে আসতে কমে অার্ধেক হয়ে যায়। আবার গ্রামে আসার পরে যাদের প্রয়েজন বেশি তারা পায়না পায় বিতরণ কারিদের পরিচিত কাছের মানুষ। তার কিন্তু ইচ্ছে করলেই কিনতে পারে এমন মানুষ। দেশের মানুষ শুধু আমার বোঝে, আমাদের বোঝে না। শীতকে এজন্য আমি বলি বড়লোকদের ঋতু। সুনীলের কথা শুনে আমি রিফাত ও ওসাকা চুপ করে রইলাম। কী বলবে বুঝতে পারছিলাম না। সুনীল সব সময় এমন ওর ভালো লাগা মানে জিনিস টার ভাগ্যের ব্যাপার। ও কখনো কোনো কিছু পছন্দ করার আগে তার খারাপ দিক বিবেচনা করে। সুনীল আমার সঙ্গী হলেও ও মানসিকতা অন্য রকম। কখনো ওকে হিসাবে বাইরে একটা টাকাও খরচ করতে দেখিনি। কেউ যদি কিপ্টা বলে ও হেসে বলবেই এটা কিপ্টামি না এটা মিত্রব্যায়ী।
ওর বলা প্রতিটা কথা আমার কানে বাজতে লাগলো। আমরা প্রতিদিন কত টাকা কত ভাবে খরচ করি কিন্তু কখনো সেই টাকা দিয়ে কাউকে সাহায্য করার কথা ভাবিনি। সুনীল কে প্রায় দেখি স্টেশনে বসে থাকে। স্টেশনে সব শিশুরাই ওকে কম বেশি চেনে। যদি আমরা জিজ্ঞেসা করি তুই স্টেশনের মত নোংরা জায়গায় ছাড়া বসে থাকার জায়গায় পাস না। ও এক গাল হাসি নিয়ে বলে এখনো বসলে পৃথিবীর মাঝে যে একটা কঠিন করুন পৃথিবী আছে তা দেখা যায়।আজ বুঝতে পারলাম কেনো সুনীল স্টেশনে যায়। আমরা তিন জন ভেবে দেখলাম শীত এই পৃথিবীর গরীব মানুষের জীবনে একটা অভিশাপ। তবে আমরা সবাই যদি এই সব অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে পারি ঠিক মতো তবে তাদের শীতে কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে।
রিফাত বললো তাহলে আমার আমাদের মিশন শুরু করবো স্টেশন থেকে যে যে ভাবে পারি। ওসাকা বললো আমরা যদি একটা সাইনবোর্ড লিখে রাখি কেমন হবে যেখানে লেখা থাকবে “মানুষ মানুষের জন্য আপনার পুরানো এবং নতুন শীতের কাপড় হতে পারে একজন শীতাতের মুখে হাসি ফুটানোর পণ্য” এভাবে কানেকশন করে আমরা কিন্তু মানুষ কে সাহায্য করতে পারি। কী বলিস তোরা। সুনীল বললো তোর আইডিয়া খারাপ না কাল থেকে শুরু করবো আমাদের এই মিশন। এখন আমাদের সাথে অনেক কাজ করেছে। আমাদের ও ভালো লাগে তবে এখন আর বলিনা আমরা শীত আমাদের প্রিয় ঋতু।