আমাদের ছাত্রজীবনে পড়া-লেখায় প্রবল প্রতিযোগিতা ছিল। বিশেষত: পাবলিক পরীক্ষায় কিভাবে সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া যায়, তার জন্য মেধাবীদের নানা কৌশল ও পরিকল্পনার অন্ত ছিল না। তাদের মনোযোগী হয়ে বই কিতাব অধ্যয়ন, প্রয়োজনীয় বিষয়ের নোট লিখন, প্রশ্নোত্তর তৈরী এবং বিভিন্ন সময়ে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ছাত্রদের নোট সংগ্রহ প্রবণতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এক যুদ্ধময় জীবন, কে কাকে ফেলতে পারে তার মহড়া। আমিও চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ভাবতে থাকি, কি করে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়। আমরা খবর নেই কে কখন কোথায় কিভাবে মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে বিজয়ের মালা পরেছে। সেই ছাত্রজীবনে দেশবরেণ্য যে ক’জন মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া মেধাবীমুখ বীর সেনানীর নাম শুনেছি তন্মধ্যে উস্তাজুল মুহাদ্দিসীন, আলিমদের শিরোমণি ও শাইখুল হাদীস শাহ আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ.) অন্যতম। উল্লেখ্য, তখন আলিম সমাজে তাঁর সুনাম-সুখ্যাতি ছিল আকাশ ছোঁয়া। কারণ তিনি ছাত্রজীবনে পাবলিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া এবং কর্মজীবনে সরকারী আলীয়া মাদরাসার সর্বোচ্চ পদে আসীন একজন সফল আলিম ছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, সেই আমলে তাঁর নোটের আলাদা কদর ছিল। বলা যায় তিনি মেধা তালিকায় স্থান পাওয়াদের পুরোধা ছিলেন। প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমার ছাত্রজীবনে তাঁকে একবারও দেখার সুযোগ হয়নি। তবে কেন জানি ঈর্ষনীয় মেধার অধিকারী এই শাইখুল হাদীস আলিম-ই-দ্বীনের প্রতি আমার অগাধ ভক্তি- শ্রদ্ধা ছিল।
একদা শুনতে পাই সেই কিংবদন্তী উস্তাজুল মুহাদ্দিসীন সিলেট সরকারী আলীয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে থেকে অবসরে গেছেন এবং চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে শাইখুল হাদীস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। যোগদানের পর আমি একদিন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। সুন্দর পরিপাটি নুরানী চেহারার এক শুভ্রশশ্রæমন্ডিত হুজুর, খুবই মায়াবী অথচ তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের আভা চোখে-মুখে প্রস্ফুটিত। পরিচয় দিলাম, আমি এই মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র এবং সাবেক প্রভাষক (আরবী) ছিলাম। বল্লাম, আমি আপনার অনেক সুনাম শুনেছি, আজ নিজ চোখে আপনাকে দেখতে এসেছি- শুনে খুশি হলেন, মুচকি হাসলেন আর খোশগল্প করলেন। আজও তাঁর সেই মুচকি হাসি চোখে ভাসে। সেদিন কথা বলে মনে হলো, তিনি সদালাপী ও মিষ্টিভাষী সাদাসিধে অসাধারণ অমায়িক এক আলিম-ই দ্বীন। এরপর তাঁর সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এতে করে তাঁর সাথে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। সত্যি বলতে কি আমি তাঁর কাছে যখনই গিয়েছি পিতৃস্নেহ পেয়েছি। আমি যেমন তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম, তিনিও আমাকে তেমন স্নেহ করতেন। তাঁর মাঝে ছোটদের প্রতি স্নেহ ও বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গুণ ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মূলত: এটি সুন্নাতে নববী, যা প্রিয় নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষায়: “যারা বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করে না তারা আমার প্রকৃত উম্মত নহে।” তিনি একজন হাদিস বিশারদ হিসেবে সুন্নাতে নববীর পূর্ণ পাবন্দ ছিলেন। তাঁর ঈমানি চেতনা ও নবীপ্রেম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন আশিকে রাসুলের পরিচয় বহন করে।
আমার ইচ্ছে ছিল একদিন তাঁর দারস বসবো, কিন্তু সুযোগ হয়নি। তবে বুখারী শরীফের দাওয়াতে অনেকবার তাঁর জ্ঞানগর্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। আলহামদুল্লিাহ, অনেক গভীর থেকে আলোচনা করতেন। তাঁর প্রতিটি আলোচনায় নতুনত্ব ছিল, জানার ও শেখার মত অনেক বিষয় ছিল, যা আমার মতো নবীনদের বিমোহিত ও অনুপ্রাণিত করতো। বিশেষ করে ইলমে রিজালে তাঁর গভীরতা অসাধারণ (হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবনী সংক্রান্ত ইলম), যা সচরাচর বাঙ্গালী আলিমদের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। বাস্তবে আমরা গতানুগতিক সিলেবাসভূক্ত কিছু হাদীসের পাঠদান করি মাত্র। তবে তিনি গতানুগতিক কোন আলিম ছিলেন না। বরং তিনি বহুবিধ জ্ঞানের পন্ডিত ছিলেন। ইলমে হাদীস ছাড়াও ইলমে তাফসীর, ইলমে ফিকহ ও ইলমে তারিখসহ নানাবিধ বিষয়ে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর এক ছাত্র থেকে শুনেছি, হুজুর প্রচুর পড়া লেখা করতেন এবং তাঁর দারস ছিল তথ্য সমৃদ্ধ ও জ্ঞানগর্ব, যা শিক্ষার্থীদের খোরাক মেটাতো। তাই অল্পসময়েই তিনি ছাত্রদের সরে-তাজে পরিণত হন। অধ্যাবসায়ী হুজুর এক মিনিট সময়ও নষ্ট করতেন না। সব কিছু যথাসময়ে আদায় করার চেষ্টা করতেন। এটি আমাদের জন্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয় আদর্শ। এমন আলিম’র জন্যই রয়েছে আল্লাহ’র নিকট দারাজাত। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান গ্রহণ করেছে এবং যাদেরকে ইলম দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে বহু মর্যাদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।” [আল-কুরআন (আল-মুজাদালা) ৫৮: ১১]
তিনি নিরহংকারী হলেও অসম্ভব আত্মসম্মানবোধ ও উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিত সম্পন্ন আলিম ছিলেন। তিনি সাধারণত: দোকানে কিংবা মাদরাসা হোস্টেলে গিয়ে নাস্তা কিংবা পানাহারগ্রহণ করা থেকেও বিরত থাকতেন। এমন কি আত্ম-সম্মানে আঘাত হয় এমন কোথাও যেতেন না। শুনেছি তিনি অপ্রয়োজনে মাদরাসা অফিসেও যেতেন না। এমনকি মাসিক হাদিয়ার (বেতন) জন্যও না। অফিস সহকারী এসে তাঁর সম্মানী দিয়ে যেতেন। বাস্তবত: অর্থ ও স্বার্থের কাছে তাঁর আত্মসম্মান বিকিয়ে দেয়ার নজীর নেই। আর তাঁর চাল-চলন, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ ও বচন-ভূষণে আভিজাত্যের চাপ থাকতো, যা সাধারণত: আমাদের দেশের আলিম-ওলামার মাঝে খুব কম দেখা যায়। তবে এটি সত্য যে, তাঁর মধ্যে কোন ধরণের বাহুল্যতাও ছিল না। ইলমী পান্ডিত্যই তাঁকে অসাধারণ ব্যক্তিতে পরিণত করেছে এবং বিশালত্বের আসনে বসিয়েছে। আমি তাঁর জানাযায় দেখেছি, সবস্তরের আলিম-ওলামার মেলা। অসংখ্য আলিম তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে হাজির হয়েছিলেন। সবার মুখে ছিল তাঁর গুণগান। কি সুন্দর কলমা পড়ে তাঁর মৃত্যু! মুহুর্তেই চলে গেলেন রবের দরবারে! আল্লাহ বলেন, “হে প্রশান্তচিত্ত! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও, আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।” [আল-কুরআন (আল-ফাজর) ৮৯: ২৭-৩০]
তিনি মেধায়, মননে, বিচক্ষণতায় ও সৃজনশীলতায় অনন্য ছিলেন। বলা যায়, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ জীবন্ত এক আদর্শ শাইখুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ.)। তিনি মেপে মেপে কথা বলতেন। তাঁর কথার ওজন ছিল, যার কারণে আলিম সমাজ তাঁকে অত্যধিক সমীহ করতো। তাঁর মধ্যে কোনধরণের হালকাপনী ছিল না, ভাবগম্ভীর- তবে খোশমেজাজ তাঁর সর্বজনস্বীকৃত। আমার কাছে বেশি ভালো লাগতো তাঁর ইলমী খোশগল্প। তিনি বড় বড় মনীষিদের জীবনগল্প জীবন্ত করে বলতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মহান ব্যক্তিত্ব সমসাময়িক বিষয়েও গভীর জ্ঞান রাখতেন।
তাঁর রুচিবোধও আমাকে টানতো। তিনি যেনতেন পোশাক পরতেন না, যেনতেন খেতেন না, যেনতেন চলতেন না। চলনে, বলনে, পরনে ও ভক্ষণে সাফ-সুতরে সুন্দরতম এক শাইখুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ,)। মূলত: তাঁর মধ্যে ছেলেমি-বুড়োমির কোনটারই স্থান ছিল না। সবকিছুতে তাঁর উচ্চমান রুচি বলাইবাহুল্য। বলতে গেলে আমলীজিন্দেগীতে কোনধরণের ভন্ডামি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। রিয়্যালিটি তাঁর আমাদের জন্য বড়পাঠ। আমি দেখেছি তাঁর মাঝে একজন নির্ভরযোগ্য হক্কানি মুখলিছ আলিম’র প্রতিচ্ছবি। অধুনা তাঁর মত সর্বজন শ্রদ্ধেয় আ’লা মর্যাদার আলিম পাওয়া ভার। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই; আছে শুধু তাঁর রেখে যাওয়া অনুপম আদর্শ। আমার ধারণা, তাঁর মত শাইখুল হাদিসের আদর্শ অনুসরণেই রয়েছে আমাদের সঠিক পথের দিশা। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের আ’লা মকামে আসীন করুক, এই দু’আ রইল। আমীন।
লেখক: মুহাম্মদ আবদুল কাদের নিজামী।
মুহাদ্দিস, গারাংগিয়া ইসলামিয়া কামিল (এম,এ) মাদ্রাসা, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।
Please follow and like us: