শুভ্র শরতের বিদায় ঘটতেই বরেন্দ্রর মাঠজুড়ে উঁকি দিচ্ছে সোনালি ফসল। মূলত- অগ্রহায়ণ মাসকে বলা হয়, ধান কাটার মৌসুম। দিগন্ত জোড়া মাঠে এখন চলছে ধান কাটার উৎসব। মাঠের পাকা ধান আর ঘরে-ঘরে পিঠাপুলির আয়োজনের মধ্যে দিয়ে এই হেমন্তেই শুরু হয়ে যায় নবান্ন উৎসব। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে তাই কৃষক-কৃষাণীর উঠোনে এখন নতুন ধানের ম ম গন্ধ বিরাজ করছে।
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী অগ্রহায়ণের রবিবার প্রথম দিনই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে আয়োজন করা হয়েছিল এমনই এক বর্ণিল নবান্ন উৎসবের।
এর আগে শনিবার (১৬ নভেম্বর) বিকেলে বরেন্দ্রের গ্রামীণ এই জনপদে নেচে-গেয়ে ধান কাটার মৌসুম শুরু করেছেন এখানকার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নারীরা। নাচ-গান ছাড়াও সেখানে ছিল ভিন্নধর্মী সব খেলাধুলার আয়োজন। তারই মধ্যে চলছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্য।
সাধারণত প্রতিবছরই এই গ্রামে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। আবহমান বাংলার এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক মনিরুজ্জামান মনির গেল ছয় বছর ধরেই আয়োজন করছেন নবান্ন উৎসবের।
এবারও তিনি গ্রামের সবাইকে নিয়ে আয়োজন করেন এই উৎসবের। এদিন তাই রাজশাহীর গোদাগাড়ীর চৈতন্যপুর গ্রামজুড়ে বইছে খুশির বন্যা। বিশেষ করে এই দিনটিকে ঘিরে উৎসব-আনন্দে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই গ্রামের মানুষের চোখে-মুখে দেখা যায় খুশির ঝিলিক।
পয়লা অগ্রহায়ণ উপলক্ষে গ্রামের এ উৎসবের দিন কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে ভালো খাবার তৈরি করা হয়। বাড়িতে মেয়ে-জামাই ও আত্মীয়-স্বজনরা আসেন দাওয়াতে। দুপুরের মধ্যেই বাড়ির কাজ শেষ করে সবাই চলে যান মাঠের উৎসবে।
নতুন শাড়ি পরে শুরুতেই ধারালো কাস্তে হাতে ধান ক্ষেতে নামেন নয়জন নারী। জাতীয় সংগীতের পর ধান কাটা উৎসবের উদ্বোধন করেন অতিথিরা। তারপর সেই নয়জন নারী চোখের পলকেই কেটে সাবাড় করেন প্রায় পাঁচ কাঠা জমির ধান।
ক্ষেতের পাশেই ছিলেন সারা গাঁয়ের মানুষ। বাইরে থেকে আসা আমন্ত্রিত অতিথিরা ছিলেন। আর তখন সবার চোখই ছিল মামনি তির্কি, চম্পা খা খা ও ঝিনুক মালাদের দিকে। এবারও তাদের ধান কাটার গতি সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছে।
শুরুতেই ধান কাটার প্রতিযোগিতায় নামেন ফর্সাপাড়া গ্রামের রেখা কুজুর, স্বপ্ন লাকড়া, উরিনা লাকড়া; কান্তপাশা গ্রামের সুচি মিনজ, রোজিনা টপ্পো, মামনি তির্কি এবং ফর্সাপাড়া গ্রামের বিমলা বেগ, ঝিনুক মালা ও চম্পা খা খা’র দল। ফর্সাপাড়া গ্রামের রেখা কুজুরের দল সবার আগে নিজেদের সারির ধান কেটে প্রথম হয়।
প্রতিযোগিতায় নেমে তিনজনের প্রতিটি দলকে লম্বালম্বি ২১ গোছা ও চওড়ায় ১৪ গোছা ধান কাটতে হয়। মোট ধানের গোছা হয় ২৯৪টি।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর চৈতন্যপুর গ্রামে প্রাচীন নবান্ন উৎসবকে ঘিরে এমন প্রতিযোগিতা হচ্ছে গেল ছয় বছর ধরে। আর গত তিন বছর প্রথম হয়েছে ফর্সাপাড়া গ্রামের রেখা কুজুরের দল। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে এবারও তারা দখল করে নিয়েছে শীর্ষস্থান। অনুষ্ঠান শেষে প্রথম হওয়া তিন নারীকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় শাড়ি। অন্য দুই দলের ছয় নারী পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন একটি করে রঙিন গামছা।
কৃষিক্ষেত্রে ভালো অবদান রয়েছে এমন একজন ব্যক্তিকে প্রতি বছরই এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আনা হয়। আজকের এই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন রাজশাহীর তানোরের স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী ও জাতীয় কৃষি পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক নূর মোহাম্মদ; অসহায় মানুষকে বিনামূল্য ভেষজ চিকিৎসা দেওয়া বগুড়ার কাহালুর আব্দুল কাদের খান এবং নওগাঁর শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর আলম শাহ। ছিলেন রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহীর ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম খাতুন। অনুষ্ঠানে ফুলের মালা পরিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিশোরীরা অতিথিদের বরণ করে নেন।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) উম্মে ছালমা বলেন, আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপ কল্পনা করলেই চোখে ভাসে নবান্ন উৎসবের কথা। এটি বাংলার কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে মিশে আছে বহুকাল ধরেই। এক সময় কার্তিককে মরা কার্তিক হিসেবে জানত সবাই। তবে সেই মরা কার্তিক এখন আর নেই। কার্তিক শেষ, অগ্রহায়ণের শুরু এই সময়ে নতুন আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষকের ঘরে ঘরে আমন ধান উঠছে। এই সময়ে নবান্নের উৎসবকে সবাই দারুণভাবে উপভোগ করেন। কাজেই এই ধরনের অনুষ্ঠানকে তিনি সাধুবাদ জানান। আর এটি কৃষি ও কৃষকের সুন্দর স্মৃতি বলেও উল্লেখ করেন জেলার ঊর্ধ্বতন এই কৃষি কর্মকর্তা।