
১২ নভেম্বর ১৯৭১। তখন চলছিল পবিত্র রমজান মাস। সেহরী খাবার সময়। পীর বাড়ীর লোকজন সেহরী খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ সময় হঠাৎ আগমন ঘটে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যদের। সাথে সহযোগিতায় ছিল চিহ্নিত রাজাকার বাহিনীর কয়েক জন। কিছু বুঝে উঠার আগেই হাত বেঁধে ফেলা হয় পরিবারের কয়েকজন পুরুষদের। সেইসময় বাড়ীর মহিলা ও অপ্রাপ্ত ছেলে মেয়েরা চরম আতংকিত হয়ে পড়ে। পাকবাহিনীর সদস্যরা বার বার মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানতে চাচ্ছিল। কিন্তু কেউ কোন উত্তর না দেওয়াতে তারা আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে পরিবারের হাত বাধা পুরুষদের কে নির্যাতন করতে থাকে। এদের মধ্যে শহীদ আ. সালাম লালুকে অসহ্য নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়। যা ঘটেছিল পরিবারের সবার সামনে। উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে ভয় দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য জানা। কিন্তু এরপরও যখন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কোন তথ্য আদায় করতে পারলো না, তখন একে একে পরিবারের প্রাপ্ত বয়স্ক সবাইকে বুলেটের আঘাতে আঘাতে বুকগুলো ঝাঝড়া করে দেয়া হলো।
এভাবে পীর পরিবারের একসাথে ১১ জন ব্যক্তি নির্মমভাবে শহীদ হলেন। তারা হলেন ১। শহীদ পন্ডিত দবির উদ্দিন (ম.ম), ২। শহীদ পীরে কামেল মৌলভী বেলায়েত হোসেন, (ম.ম), ৩। শহীদ হাবিবুর রহমান (ম.ম.) ৪। শহীদ জাহেদুর রহমান (মুকুল), ৫। আব্দুস সালাম লালু ৬। খলিলুর রহমান (ধলু), ৭। শহীদ মুন্সী আজগর আলী, ৮। শহীদ মজিবর রহমান ৯। শহীদ ভুলু ১০। শহীদ হায়দার আলী ১১। শহীদ মফছের আলী। সেই রাতের নির্মম দৃশ্যবলীর প্রত্যক্ষদর্শী শহীদ বেলায়েত হোসেনের ছোট ছেলে ও পীর ডা. কহ্বরুল্লাহ দাখিল মাদ্রাসার বর্তমান সুপার মো. ওবায়দুর রহমান রানা পীর পরিবারের সেই গণহত্যার ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এখনও আবেগাপ্লোত হয়ে পড়েন। তিনি আরো জানান, আসলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পীরবাড়ীতে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ই ছিল গণহত্যার মূল কারন।
সেইসাথে স্থানীয় রাজাকারদের স্বার্থ হাসিল ও লুটপাটও একটি অন্যতম কারন হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন। জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া বীরমুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন, আব্দুল জলিল ও মোকছেদুর রহমান ঠান্ডু পীর পরিবারেরই সদস্য। তারা ছাড়াও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাগণ পীরবাড়ীতে অবস্থান করতেন। স্থানীয় রাজাকাররা এ খবর পাকবাহিনীকে দিলে তারা পরিকল্পিতভাবে এ গণহত্যা চালায়। যদিও সেই সময় বাড়ীতে আশ্রিত কোন মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন না। এদিকে স্বাধীনতার অনেক বছর পর রামশহর পীরবাড়ী চত্বরে স্থাপিত শহীদের কবরগুলো জেলা পরিষদের বরাদ্দ অর্থে সংস্কার করা হলেও শহীদদের পরিবারের জন্য রাষ্ট্রিয়ভাবে তেমন কোন কিছুই করা হয় নি। বরং শহীদ ভুলু মিয়ার বিধবা স্ত্রী মোছা. রওশনারা বেওয়া ও শহীদ হায়দার আলীর স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে মোছা. আঙ্গুরা খাতুন বর্তমানে জীবিত থাকলেও তারা অতি মানবেতর জীবন যাপন করছেন বলে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মাদ্রাসা সুপার ওবায়দুর রহমান রানা জানিয়েছেন। তিনি শহীদ পরিবারের জন্য বিশেষ করে শহীদ পরিবারের যারা অতি কষ্টে জীবনযাপন করছেন তাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তৃপক্ষের নিকট দাবী জানান। সেইসাথে শহীদ পরিবারের হাতে গড়া পীরবাড়ী চত্বরে স্থাপিত রামশহর ড. পীর কহ্বরুল্লাহ (রহ.) দাখিল মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।