আবু হাসান টিপু
ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধের নাম করে ভিক্ষুকের ভিক্ষের থালা কেড়ে নেয়ার মধ্যো দিয়ে নিশ্চয় কোন কৃতিত্ব নেই। এতে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হবেনা। বরং এটা হবে একজন নিরন্য মানুষের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেয়ার সামিল; একটি অমানবিক কর্ম। সেটা কোন জনপ্রতিনিধি করুক আর স্থানীয় সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হোক। তথাকথিত জন গুরুত্বপূর্ণ কাজের দোহাই দিয়ে হোক অথবা নিজেকে অতি করিৎকর্মা প্রদর্শনের লালসাতেই হোক। অমানবিকতা কখনোই শান্তির বার্তা বহন করেনা।
গত সপ্তা খানেক ধরে নারায়ণগঞ্জের বিপনী বিতানগুলোর সামনে থেকে হকারদের উচ্ছেদ করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ প্রশাসন খুব সস্তায় মারহাবা কেনার মওয়া লুফে নিয়েছেন। ওনাদের বক্তৃতা বিবৃতিতে মনেই হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ থেকে হকার উচ্ছেদ করে যেন মহাভারত উদ্ধার করে ফেলেছেন। যেন পতিতা পল্লীর মতো হকাররাও নারায়ণগঞ্জেরবাসী সবচেয়ে লজ্জার যায়গা ছিল, দুনিয়ার সকল অপকর্ম কেবল ওরাই করতো, আর তাই, যেন শহরকে হকার মুক্ত করেই শহরবাসীর সকল সমস্যা সমাধান করে ফেলেছেন।
অথচ বছরের পর বছর ধরে সিটি কর্পোরেশনের নামে যখন প্রত্যেক হকারের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অংকের দৈনিক মাশোহারা নেয়া হতো তখন মেয়র মহোদয় নিশ্চুপ ছিলেন, হকার উচ্ছেদে ‘বড় ভাই’দের সদ ইচ্ছা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বড় ভাইদের চেলা চামুন্ডারা যখন একই কায়দায় মাশোহারা গুনতেন তারাও তখন আবার এটাকে সিটি কপোরেশনের একতিয়ার ভুক্ত কর্ম বলে এড়িয়ে যেতেন। পুলিশের কথা আর কি বলবো, ওনারাতো সকালে থানা পুলিশের নামে আর বিকেলে টহল পুলিশের নামে এক দিনেই দুইবার মাশোহারা গ্রহন করে আসছে বছরের পর বছর। কে না জানে এসব চোর চোট্টাদের লুটপাটের কাহিনী। ‘নারায়ণগঞ্জ নাট্যের’ ভাই বোন অভিনিত নাটকের কোন কুশিলব এই হকারদের পয়সায় আয়েস করেন না? এই নাটক আর কত দিন চলবে? আর কবে টোকাইয়ের গালে চর মেরে হিরো সাজার প্রবনতা লোভ পাবে নারায়ণগঞ্জ থেকে সচেতন মানুষের এখন এটা দেখার বাকি।
সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার হিসেব মতে দেশজুড়ে প্রায় চার কোটি কর্ম ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ এখনও বেকার, দেশের প্রায় নব্বই ভাগ মানুষই দরিদ্র, ষাট ভাগের উপরে মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। এই দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষগুলোরই কেউ না কেউ আজ বিভিন্ন শহরের হকার। সামান্য পুঁজিতে ফুটপাতে বসে দেশের অপরাপর দরিদ্র মানুষগুলোর নিত্য প্রয়োজনীয় প্রণ্যর চাহিদা মিটাচ্ছে। নুন আনতে পান্তা ফরানো অসহায় দরিদ্র মানুষ গুলোর সারা জীবনের সখ আহলাদ মিটানোর, বিলাসি পন্য কেনার এক মাত্র যায়গা হলো এই ফুটপাত। আর এই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ষাষ্ট ভাগেরও বেশী। নারায়ণগঞ্জ নাট্যের ভাই কিংবা বোন অথবা তাদের সাথে সংশ্লিষ্টদের মতো এরা নিশ্চয় ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর শপিং করতে যাওয়ার সামর্থ রাখেন না। যারা হকার উচ্ছেদ করে মারহাবা কুড়াতে ব্যস্ত তারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন যদি হকারই না থাকে তবে আমার দেশের অর্ধেকের বেশী দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে কোন বাজারে যাবেন? এই লাখো লাখো মানুষ শহরের চকচকে বিপনী বিতানে যাওয়ার সাহস রাখেন কিনা?
কর্তা ব্যাক্তিরা শুধু কয়েক শত হকারকেই বড় করে দেখেন, এদের উচ্ছেদই সকল সমস্যার সমাধান মনে করছেন কিন্তু একটু ভাবছেন না, দেশের যে জনগোষ্ঠির মানুষের চাহিদা এরা পূরণ করে সেই মানুষগুলো যাবে কোথায়? কে দিবে এর উত্তর? লুটেরা ধনিক শ্রেণীর এই পুঁজিবাদী ভন্ড সমাজের এটা গতানুগতিক নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিইবা হতে পারে। নব্য ধনিকরা রঙ্গিন চশমায় যখন নিজেদের দিকে তাকায় তখন সব কিছুকেই রঙ্গিন দেখতে চায়, নিচের তলার খেটে খাওয়া নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষ গুলোকে মনে করে সমাজের উচ্ছিষ্ট। যাদের দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্র; যারা গোটা দুনিটাকেই বাচিয়ে রাখছে, যারা এই বিশে^র হারাহারি অংশিদার, মালিক; সেই তাদেরই অস্তিত্ব স্বীকার করতে যেন জাত চলে যায়। মুখে রোমাল চেপে তাকায়।
আমেরিকা ইউরোপসহ বিশে^র বহু নামি দামী শহরেই হকার রয়েছে এবং সর্বত্র ফুটপাতেই তারা পসরা সাজাচ্ছে। কৈ কোন দেশের সরকার কিংবা স্থানীয় প্রশাসনতো তাদের এভাবে সমূলে উচ্ছেদ করেন না। শহর মানেই নাগরিক কোলাহলে পূর্ণ, হাজারো মানুষের উপস্থিতি, নিত্য আসা যাওয়া। আর এ কারণেই ঐ চলন্ত পথের পথিকের দৈনন্দিন কেনাকাটার চাহিদা মেটাতে অনিবার্য ভাবেই গড়ে উঠে ফুটপাতে সস্তায় বিক্রয়লব্ধ বাহারি পণ্যের পসরা। এ যেন প্রকৃতিরই স্বাভাবিক নিয়ম। কার সাধ্য আছে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাবে। মারহাবা প্রত্যাশীরা সাময়িক প্রতিবন্ধকতা হয়তো সৃষ্টি করতে পারবেন ঠিকই কিন্তু চুড়ান্ত বিচারে সকল বাধা অতিক্রম করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কারো কারো মুখে চুন কালি মেখে আবার ফুল ফুলে ভরে উঠবেই বাগান।