উন্নত প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে আদি গ্রামীণ সাধারণ মানুষের খেলাধুলা। এক সময় গ্রামগঞ্জের ছেলে মেয়েরা পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলায় অভ্যস্ত ছিল। তারা অবসর সময় ছেলে-মেয়েরা দলবেঁধে খেলতে যেত গ্রামের খোলা মাঠে, বাড়ির উঠানে। পুকুরে ঝাপ দিয়ে গোসল করাসহ শৈশবে দুরন্তপনায় জড়িয়ে থাকতো বিভিন্ন খেলাধুলার মাধ্যমে। আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেট গ্রাস করছে তরুণ প্রজন্মকে। এর প্রভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা। কিন্তু এসব খেলাই আজ স্মৃতির খাতায় লেখা হয়ে গেছে।
এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা গ্রামবাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য এসব গ্রামীণ খেলাধুলা তো করেই না, নাম জানে কিনা সেটি এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এখন যেন তা রূপকথার গল্প। ঘরে বসে কম্পিউটার, মোবাইলে গেমস খেলতেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার কারণে এখন আর বিকেলে মাঠে দেখা যায় না কিশোর-কিশোরীদের।
উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রামীণ খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট হারাচ্ছে অনেকেই। তাই বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাগুলো। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও উদ্যোগ নেওয়া হলে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এসব গ্রামীণ খেলাধুলার সঙ্গে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাড়ির সম্পর্ক, ঐতিহ্যের ধারা। এসব খেলার তাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের উচিত গ্রমীণ খেলাধুলা বেশি করে আয়োজন করা। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর পরিচিতি ও তার সুফল সম্পর্কে আকৃষ্ট করা।
গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের প্রাচীন ক্রীড়া সংস্কৃতি। একসময় গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করত। বর্তমানে গ্রামীণ খেলা বিলুপ্ত হতে হতে আজ তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই কঠিন। দেশের বিভিন্ন এলাকার গ্রামাঞ্চলে একসময় প্রায় শতাধিক গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচলন ছিল। তার মধ্যে ছেলেরা খেলত হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, কাবাডি, সাতগুটি, ষোলগুটি, লাটিম ঘোরানো, ঘুড়ি উড়ানো, দড়ি লাফ, গাদন, মার্বেল, কপালটোকা, কানামাছি, মালাম খেলা, কুস্তি, ডুব সাঁতার, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, হৈল বৈল, বস্তাদৌড়, ফুটবল, লুকোচুরিসহ এমনি আরও অনেক খেলা। আর মেয়েরা খেলত গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, এক্কাদোক্কা, চোর-পুলিশ, বৌছি, কুতকুত, কড়িখেলা, বালিশ বদল, ইচিং বিচিং, লুকোচুরি, পুতুল খেলা, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, এলাটিং বেলাটিং, চেয়ার খেলা, লুডু, রান্নাবাটিসহ বিভিন্ন খেলা। খেলাগুলোর মধ্যে এখনও হা-ডু-ডু, কাবাডি, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলাসহ হাতেগোনা কয়েকটির প্রচলন আছে। গ্রামাঞ্চলে পহেলা বৈশাখ, মহরম ও গ্রামীণ উৎসবে এখনও এসব খেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার পরিবর্তে অনেকদিন আগেই এদেশে প্রচলন হয় ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার। ক্রিকেট খেলা আমাদের দেশীয় খেলা না হলেও বর্তমানে তা আমাদের দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
কিন্তু বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে অতীতের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাকে। এছাড়াও বর্তমানে শহরাঞ্চলে তো বটেই গ্রামাঞ্চলেও খোলা জায়গা বা খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে অনেক গ্রামীণ খেলা বন্ধের পথে। ফলে বর্তমানে ভিডিও গেমস, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি গ্রামীণ খেলাধুলার স্থান দখল করে নিয়েছে। ফলে ছেলেমেয়েরা একটু সময় পেলেই মেতে ওঠে এসব যান্ত্রিক জিনিস নিয়ে। পড়াশুনা যেমন ছেলে-মেয়েদের মানসিক বিকাশ ঘটায়, তেমনি শারীরিক বিকাশ ঘটাতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই।
অতীতের সময়ে প্রতিবছর সব স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাগুলোতে নানা ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করা হতো। বর্তমানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো খেলার মাঠও নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশ ঘটছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত অচিরেই গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। পরিণত হবে রূপকথার গল্পে। এখন, মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে প্রজন্মকে রক্ষা ও গ্রামীণ খেলাকে বাঁচাতে এদেশের সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে এসে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। এরসঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধির মাধ্যমেই কেবল অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মানস গঠনে শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। খেলাধুলা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি অনুধাবন করে প্রতি বছর বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। বছরব্যাপী তৃণমূল পর্যায় থেকে বালক ও বালিকাদের বাছাই করে আয়োজন করা হয় এ টুর্নামেন্টের।