সম্প্রতি ভারতের একজন মূখ্যমন্ত্রী গরুর মুত্র এবং গোবরের উপাকারিতা বর্ণনা করেছেন সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিকভাবে। ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত, যিনি উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি তিনি বলেন , ‘‘গরু যেমন অক্সিজেন গ্রহণ করে, তেমনই অক্সিজেন ছাড়েও৷ আমাদের বাঁচার রসদ দেয় বলেই তাকে মায়ের স্থান দেওয়া হয়েছে৷ গোটা শরীরের জন্য গোবর ও গোমূত্র খুবই উপকারী। হার্ট-কিডনির রোগ নিরাময়ে তা সাহায্য করে৷ গরুর কাছাকাছি থাকলে টিবি রোগ সেরে যায়।” তিনি দাবি করেন, বিজ্ঞানীরাও নাকি তাঁর এই মতবাদকে প্রশংসাপত্রের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছে। মন্ত্রীর এই অযুক্তিক অবৈজ্ঞানিক বক্তব্য শিক্ষিত সুশীল সমাজ মন্ত্রীকে বিতর্কিত করে। একজন মন্ত্রী যে এসব আজগুবি কথা কেবল জনগণকে খুশি করতেই বলেছেন, তা বলা বাহুল্য। ইদানীং কালে ভারতে গো মুত্রের চাহিদা জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। তাই যতই অযুক্তিক বা অবৈজ্ঞানিক হোক না কেনো, সে দেশের জনগণের মনের ইচ্ছাকে নেতারা যে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখেন তা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
আর আমাদের দেশের জনগণের দুর্ভাগ্য দেখুন! আমাদের দেশের নেতারা জনগণের কষ্ট নিয়ে উপহাস করেন। জনগণ তাদের কোনো কষ্টের কথা সমস্যার কথা গণমাধ্যমকে বলতেও পারবে না। অতীত উদাহরণ দিতে গেলে বই লেখা হয়ে যাবে, কেবল সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুই-একটা ঘটনা মনে করতে পারি। মাত্র দু’মাস আগে আমাদের দেশের জনগণ ডেঙ্গু রোগে মারা যাচ্ছিল। এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক ভয়াবহ ছিলো। জনগণ যখন চারদিকে আতঙ্কগ্রস্ত ভয় ভীতির মধ্যে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিলো, হাসপাতালে ভর্তির জন্য সীট পাচ্ছে না। বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর ছড়িয়ে পড়ছে, তখন এক মেয়র হুমকি দিলেন-এসব বললে নাকি মামলা দিবেন, আরেকজন মেয়র রেগে বললেন- এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে । যাক, সত্য স্বীকার করতে আমাদের নেতাদের অনেক কষ্ট হয়। তবুও ভালো যখন ডেঙ্গু মহামারী রূপ ধারণ করলো, তখন নেতারা মশা মারার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। ভারতের নেতার মতো কেউ বললেন না, আপনারা ধৈর্য ধরুন আমরা আপনাদের পাশে আছি। আমাদের নেতাদের থেকে কখনও ভালোবাসার কথা আশা করিও করি না।
এমনি জনগণকে আরেকটি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গত দু’মাস ধরে সেটি হচ্ছে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি। সচরাচর প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য 20-30 টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সেই পেঁয়াজ গত দু’মাসে বাড়তে বাড়তে 140 টাকা কেজি খুচরো মূল্য হয়। যে পরিবারে মাসে 10কেজি পেঁয়াজ লাগে সেখানে 30টাকার স্থলে যখন 130 টাকা মূল্য দিতে হয় তখন অতিরিক্ত 1000 টাকা গুনতে হয়। কেবল একটা নিত্য পণ্য পেঁয়াজ কিনতেই যদি 1000 টাকা এক মাসে বেশি খরচ করতে হয়, তাহলে অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে কত টাকা বাড়তি গুনতে হবে? এই বাড়তি টাকা আসবে কীভাবে? জনগণ ক্যাসিনো জুয়া খেলে টাকা রুজি করে না। তাদের কাছে অতো কোটি কোটি অবৈধ টাকা নেই। তারা বাজারে নিত্য পণ্য কিনতে গেলে মাথায় আগুন জ্বলে উঠে। বাজারে গেলে দেখা যায় দ্রব্যমূল্যের কী যে বৃদ্ধি হয়েছে যা বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিটা শবজী ষাট টাকা থেকে নব্বই টাকা পর্যন্ত। মাছের বাজার আরোও ভয়াবহ। চারশ টাকার নিচে মাছ নেই। সবচেয়ে বিপদজনক হয়ে দেখা দিয়েছে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য পেঁয়াজের দাম। শেষ পর্যন্ত পেঁয়াজ 160 টাকা কেজিতে উন্নীত হয়েছে। যারা নির্দিষ্ট আয়ের উপর সংসার চালান তাদের এখন পেঁয়াজ কিনতে সাহস করেন না। তাইতো এখন অনেক বলেন, পেঁয়াজ কাটতে গেলে স্ত্রী কান্না করে আর কিনতে গেলে স্বামী কান্না করেন।
পেঁয়াজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি অতীব প্রয়োজনীয় পণ্য, যা না হলে একদিনও চলা যায় না। একমাত্র ভাত ছাড়া এমন কোনো খাবার নেই যা রান্না করতে পেঁয়াজ লাগে না। পেঁয়াজ এমন একটা পণ্য যা একাই তরকারির ভূমিকা পালন করে। যেমন-সকালে পান্তা ভাত খেতে মাত্র একটা পেঁয়াজই যথেষ্ট। এজন্য পেঁয়াজকে গরীবের শবজী বলা হয়। পেঁয়াজ এমন কোনো বিলাসী পণ্য নয় যা কয়েকদিন না থাকলেও অসুবিধা হবে না। এটা ধনী গরীব সবার জন্যই প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। তাই পেঁয়াজ খাবো না, পেঁয়াজ না খেলে কী হয়? আমার বাসায় পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি রান্না হয়”। কেউ কেউ এসব বেহুদা কথা বলে পেঁয়াজের গুরুত্বকে অস্বীকার করতে চায়। অন্যরা এসব হালকা কথা বললে জনগণ তেমন ব্যথিত হয় না। কিন্তু জনগণের যারা প্রতিনিধি যারা জনগণের নেতা পরিচয় দেন, যারা সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী, তারা যদি কোনো বেহুদা কথা বলেন তখন মানুষের মনে যে কীরূপ প্রতিক্রিয়া বা ক্ষোভ সৃষ্টি হয় তা বলাই বাহুল্য। একজন জনপ্রতিনিধিতো এই কথা কিছুতেই বলতে পারেন না যে, “আমার বাসায় পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি রান্না হয়”। এটা নিছক জনগণের সাথে তাদের কষ্ট নিয়ে তামাশা করা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। কারণ এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য কথা নয় ডাহা মিথ্যা কথা। বাস্তবতা এই যে, পেঁয়াজ আমাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার্য ভোগ্যপণ্য। পেঁয়াজ ছাড়া একটা ডিমও ভাজা যায় না।
10 কেজি পেঁয়াজ যেখানে 300 টাকায় পাওয়া যেতো সেখানে এখন 2 কেজি পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে 300 টাকায়। কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি যা বর্ণনা করা দূরহ।
যেখানে জনপ্রতিনিধি বা নেতা বা মন্ত্রী পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি কীভাবে দ্রুত কমানোর বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, জনগণকে সান্ত্বনা দিবেন তা না, উল্টো পেঁয়াজ না খেলেও চলে বলে যখন তামাশা করেন, তখন ভারতীয় নেতাদের থেকে রাজনীতির অ আ ক খ শিখতে অনুরোধ করা ছাড়া আমাদের আর বলার কিছু থাকে না। তাই আজ মনে প্রশ্ন জাগে- জনগণের নেতা কি আমরা পেয়েছি না ভারতের জনগণ পেয়েছে? আমাদের নেতারা কি জনগণের কষ্টের কথা একবারও ভাবেন?
লেখকঃ কলামিস্ট ও আবৃত্তিকার
arzufeni86@gmail.com