
গুইমারা(খাগড়াছড়ি)প্রতিনিধি:
আজ ২রা ডিসেম্বর।পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ২১ বছর পূর্তি।দিবসটি ঘিরে পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে নানা আয়োজন।বিভিন্ন মিছিল,সমাবেশ,সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালিত হবে।কিন্ত,এ চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করা হলেও বাস্তবে তাঁর দেখা মিলেনি আজও।কাঙ্খিত স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি পাহাড়ে।চুক্তির২১ বছর পরেও পাহাড়ে থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি।এখনও গোলাগুলির শব্দে গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গে এখানকার মানুষের।সশস্ত্র সংঘর্ষে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, অপহরণ,গুম,ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির ঘটনা অব্যাহত ভাবে চলছে।তারি সাথে সন্ত্রাসী বাহিনী গুলোর আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত,অন্ত:দ্বন্ধ আর খুনাখুনির ঘটনায় বলির পাঠা হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।আগে শান্তিচুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে দু‘টি গ্রুপ থাকলেও বর্তমানে চারটি গ্রুপে বিভক্ত তাঁরা।(সন্তু লারমা গ্রুপ)পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি,(এম এন লারমা গ্রুপ) সংস্কারপন্থী ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট(গনতন্ত্র)নামে বিভক্ত।এসব গ্রুপের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্ধের চেয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্রমেই দ্বন্ধ, সংঘাত,আতংক এবং ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলায়।চুক্তির পর গত ২১ বছরে এই সংঘাতে মারা গেছে উভয় পক্ষের বেশ কিছু মানুষ।এছাড়া পঙ্গুত্ব বরণ,অপহরণ,গুমের ঘটনায় আরো অসংখ্য পাহাড়ি ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের শিকার।১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সালে চুক্তি সম্পাদনের আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠন কর্তৃক অসংখ্য বর্বরোচিত,নারকীয় ও পৈশাচিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙ্গালীরা।কিন্তু কোন এক অলৌকিক কারণে বাঙ্গালীদের উপর সন্ত্রাসীদের চালানো এসব নির্যাতনের চিত্র প্রচার মাধ্যমে স্থান পায়নি।
এছাড়া ভূমির জটিলতা নিরসন না হওয়ায় ভূমিনিয়ে ঘটছে পাহাড়ী–-বাঙালীর মধ্যে সহিংস ঘটনা।তার প্রমান,গত ২০১১ সালের ৮মে খাগড়াছড়ির রামগড়ে ভূমি বিরোধের জের ধরে পাহাড়ি ও বাঙ্গালীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।১৭ এপ্রিল২০১১ গুইমারার কচুবাউন্তি এলাকায় ৩বাঙ্গালী নিহতের ঘটনায়,অনেক আহত,অগ্নিসংযোগের ঘটনা।এদিকে পাহাড়ের অশান্তি সৃষ্টিকারী উপজাতীয় কিছু কুচক্রি মহল,স্পর্শকাতর বিষয়,ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে বাঙ্গালীদের ফেলে আসা ভূমি এবং পরিত্যাক্ত সেনা ক্যাম্পের জায়গা দখল করে মন্দির ণির্মান,পরবর্তিতে ভাংচুর করে নিরাপর্ত্তা বাহিনীর উপর দায় চাপানোর কুটকৌশল,ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।তার জলন্ত প্রমান সম্প্রতি সময়ে গুইমারার কুকিছড়ার ঘঁটনা।
পাহাড়ে বসবাসকারী জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বাঙ্গালী।চুক্তিতে বৈষম্যের অভিযোগ এনে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত বাঙ্গালী সংগঠন গুলোর অভিযোগ,চুক্তির কারণে উপজাতীয়রা অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে।পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদে আসীন উপজাতীয় নেতারা।চুক্তির প্রভাবে পার্বত্যাঞ্চলে বাঙ্গালীদের অস্থিত্ব প্রায় বিলীন হওয়ার পথে।ভূমি অধিকার,ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার হারিয়ে পার্বত্য বাঙ্গালীরা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।উপজাতীয়দের জন্য শিক্ষা,চাকুরী ও ব্যবসায় কোটা থাকলেও বাঙ্গালীদের জন্য কোন কোটা নেই।ঠিকাদারী ব্যবসায় উপজাতীয়দের ট্যাক্স দিতে হয় না।দু’লাখ টাকা পর্যন্ত ঠিকাদারী ব্যবসায় উপজাতীয়দের জন্য নির্ধারিত করে রাখা হয়েছে।দেশের সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয়দের নির্ধারিত কোটা রয়েছে।কিন্তু বাঙ্গালীদের জন্য কোটা নির্ধারণ নেই।চাকুরীতে উপজাতীয়দের শিক্ষাগত যোগ্যতা একধাপ নীচে কোটা সংরক্ষণ রয়েছে।ফলে উপজাতীয়রা এগিয়ে যাচ্ছে,বাঙ্গালীদের পিছিয়ে পড়ছে।বাঙ্গালীদের ছাড়াও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা না করে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।সবকিছু মিলিয়ে পার্বত্য এলাকার মানুষকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে বসবাস করতে হচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলে।
পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিযার আলকাছ আল মামুন বলেন,পার্বত্য শান্তি চুক্তি সন্তু লারমাই মানেন না।অস্ত্র সমর্পনের মধ্যদিয়ে শান্তি চুক্তি হয়েছিল।কিন্তু অস্ত্র এখানো তাদের হাতে আছে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।এখন পর্যন্ত পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসেনি।চুক্তির বেড়াজালে বাঙ্গালীরা সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে।অনতিবিলম্ভে শান্তি বাতিল করে সকল সম্প্রদায়ের সংবিধান স্বীকৃতি অধিকার প্রতিষ্ঠান দাবী করেন তিনি।
চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে নানারূপ অভিমত রয়েছে।সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দাবী করা হলেও সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ করে সম্প্রতি গনমাধ্যমে দেয়া এক প্রেসবার্তায়,পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন,আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দুই মেয়াদে এক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।প্রকৃতপক্ষে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং মৌলিক বিষয়সমূহসহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।তবে একটি সুত্র থেকে জানাযায়,এপর্যন্ত শান্তিচুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন,১৫টির আংশিক বাস্তবায়ন এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।তিন পার্বত্য জেলায় হস্তান্তরযোগ্য ৩৩টি বিষয়/বিভাগের মধ্যে এ পর্যন্ত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৩০টি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৩০টি এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে ২৮টি বিষয়/দফতর হস্তান্তর করা হয়েছে।
২১বছর পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমেই দীর্ঘ ২৪ বছরের সশস্ত্র লড়ায়ের অবশান ঘটিয়ে শান্তিবাহিনীর প্রায় দুই হাজার গেরিলা অস্ত্রসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অন্যতম লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নিরস্ত্র করন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাহাড়বাসীর উন্নয়ন।কিন্তু এখন আরো অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং হুবাহুব নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত পোষাকের মত পোষাক,শোভা পাচ্ছে উজাতীয় সন্ত্রাসীদের গায়ে।তাদের কাছে পুরনো অস্ত্রের পাশাপাশি নতুন এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রও রয়েছে। এসবের মধ্যে আছে এম ১৬ রাইফেল, মিয়ানমারে তৈরি এম ১ রাইফেল, একে ৪৭ রাইফেল, একে ২২ রাইফেল এবং এলএমজি (লাইট মেশিনগান),হেভি মেশিনগান, জি-৩ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল ইত্যাদি ভয়ঙ্কর স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র।পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র ‘জুম্মল্যান্ড’ গঠনের দাবী করে উপজাতীয় নেতা এবং তাদের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘স্বাধীন জুম্মল্যান্ড’ গঠনের লক্ষ নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে।এ প্রেক্ষাপটে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষায় এবং পাহাড়ে শান্তিরক্ষায় সেখানে প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্প পূর্ণবহাল করে নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধিসহ চলমান কর্মকান্ড অব্যাহত রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন,সচেতন সমাজের প্রতিনিধিরা ।