আজ ১৪ ই ডিসেম্বর। বুদ্ধিজীবি দিবস। স্বাধীনতা ও সার্বভূমত্ব প্রতিটি মানব জাতির চরম চাওয়া। সবাই স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বিলিয়ে দেয় জাতির নিবেদিত প্রাণ। আবার পক্ষান্তরে হায়নারা জাতিকে নিঃশেষ করতে মেধাবীদের হত্যায় মেতে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ রাতে অপারশেন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথে সাথেই বুদ্ধিজীবিদের হত্যার পরকিল্পনা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা অপারশেন চলাকালীন সময় খুজে খুঁজে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫শে মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র কয়েকদিন আগে। যুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের প্রশিক্ষীত আধা-সামরিক বাহিনী, আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করে। যেখানে এই সব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবিদের নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ধারণা করা হয় পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। কারণ স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তার স্বহস্তে লিখিত ডায়েরী পাওয়া যায়। যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবিদের নাম পাওয়া যায়। এছাড়া আইয়ুব শাসন আমলের তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের এক সাক্ষাৎকার হতে জানাযায় যে ফরমান আলীর তালিকায় তার বন্ধু কবি সানাউল হকরে নাম ছিল। আলতাফ গওহরের অনুরোধে রাও ফরমান আলী তার ডায়েরীর লিস্ট থেকে সানাউল হকের নাম কেটে দেন। এছাড়া আল-বদরদের জন্য গাড়ীর ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন বলে তার ডায়েরীতে একটি নোট পাওয়া যায়।
ডিসেম্বর ৪ তারিখ হতে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বর ১০ তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ই ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখক-সহ চিহৃিত বুদ্ধিজীবিদের পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মত বুদ্ধিজীবিদের তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের চোখে কাপড় বেধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের উপর বিভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।
এমনকি আত্মসমর্পণ ও যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পরেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তার সহযোগিদের গোলা গুলির অভিযোগ পাওয়া যায়। এমনই একটি ঘটনায় স্বনামধন্য চলচিত্র-নির্মাতা জহির রায়হান প্রাণ হারান। এর পেছনে সশস্ত্র বাহিনীদের হাত রয়েছে সন্দেহ করা হয়। নিহত বুদ্ধিজীবিদের স্মরণে প্রতি বছর ডিসেম্বরের ১৪ তারখি “শহীদ বুদ্ধীজীবি দিবস” হিসেবে পালন করা হয়।
জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকস্তিান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু’বার বিয়ে করেন ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবিকে ও ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন। দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচিত্র অভিনেত্রী।
জহির রায়হান বাংলা সাহিত্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করনে। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসবে কাজ করা শুরু করনে। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন।
১৯৫৫ সালে জহির রায়হানের প্রথম গল্প গ্রন্থ সূর্য গ্রহণ প্রকাশতি হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পর্দাপন ঘটে ১৯৫৭ সালে জাগো হুয়া সাবেরা ছবিতে সহকারী হিসবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবিতে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসাবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে এদেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসবে আত্ম প্রকাশ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানি প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন। জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১ শে ফ্রেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে ছিল। যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়াতে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থকে নেওয়া বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্র দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করেন।
জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হবার পর তার নিখোজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করনে, যিনি স্বাধীনতার ঠুক আগমুহূর্তে পাকিস্তানি আর্মির এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। জহির রায়হান ভাইয়ের সন্ধানে মিরপুরে যান এবং সেখান থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি। মীরপুর ছিল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বিহারী অধ্যুষতি এলাকা। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সেদিন বিহারিরা ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালালে তিনি নিহত হন।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট। প্যারিস-ফ্রান্স।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া।
Please follow and like us: